সৈয়দ মুজতবা আলী : দেশে বিদেশের লেখক
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
(১৩ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৪ --- ১১ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৪)
♥¤ জন্ম ও জন্মস্থান :-
সৈয়দ মুজতবা আলী জন্মগ্রহণ করেন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের (শ্রীহট্ট) করিমগঞ্জে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল সিলেটের (শ্রীহট্টের) মৌলভীবাজারের হবিগঞ্জে।
♥¤ জাতীয়তা :- ব্রিটিশ ভারতীয় (১৯০৪-১৯৪৭)
পাকিস্তানী (১৯৪৭-১৯৭১)
বাংলাদেশী (১৯৭১-মৃত্যু)
♥¤ জাতিসত্তা :- বাঙালি।
♥¤ শিক্ষা :- পি.এইচ.ডি (তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব)।
♠¤ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান :- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
♠¤ ধর্ম :- ইসলাম।
♠¤ দাম্পত্য সঙ্গী :- রাবেয়া খাতুন।
♠¤ পেশা :-
তিনি একজন বিংশ শতকীয় বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটোগল্পকার, প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, রম্যরচয়িতা ও অনুবাদক। তিনি তাঁর ভ্রমণ কাহিনীর জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়।
♦¤ সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ :-
বীরভূমের শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা চলাকালীন 'বিশ্বভারতী ম্যাগাজিন'-এ তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ জুলাই 'দেশ' পত্রিকায় 'সত্যপীরের' ধারাবাহিক কলামের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'দেশে বিদেশে', 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)।
♦¤ ছদ্মনাম :- তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখির ক্ষেত্রে 'টেকচাঁদ রায়', 'গোলাম মৌলা', 'রায়পিথৌরা', 'সত্যপীর', 'ওমর খৈয়াম', 'প্রিয়দর্শী', 'মুসাফির'।
♦¤ শিক্ষাজীবন :-
সিলেটের গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি অধ্যয়ন করেন। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন। তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র। এখানে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয় ভাষাশিক্ষা লাভ করেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে এখান থেকে তিনি বি.এ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
♦¤ কর্মজীবন :-
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সৈয়দ মুজতবা আলী আফগানিস্তানের কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে অধ্যাপনা করেন। সেখানে তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি অবসরগ্রহণ করেন।
♣¤ লেখালেখি :-
বীরভূমের শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানের 'বিশ্বভারতী' নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে সৈয়দ মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি 'টেকচাঁদ রায়', 'গোলাম মৌলা', 'রায়পিথৌরা', ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘প্রিয়দর্শী’, 'মুসাফির' ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায়, যেমন :- 'আনন্দবাজার', 'দেশ', 'সত্যযুগ', 'শনিবারের চিঠি', 'বসুমতী', 'হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড' প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন। এছাড়াও 'মোহাম্মদী', 'চতুরঙ্গ', 'মাতৃভূমি', 'কালান্তর', 'আল-ইসলাহ্' প্রভৃতি সাময়িক পত্রেরও তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তাঁর বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী। এছাড়াও লিখেছেন ছোটোগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি হল, "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।" তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা হল ৩০টি।
♣¤ আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ :-
১) 'শবনম' (১৯৬০/১৩৬৭) উপন্যাস
২) 'গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন' (১৩৮৮) প্রবন্ধগ্রন্থ [এটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ।]
♣¤ উপন্যাস :-
১) 'অবিশ্বাস্য' (১৯৫৩/১৩৬১) [এটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।]
২) 'শবনম' (১৯৬০/১৩৬৭) [এটি তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। এটি 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।]
৩) 'শহর-ইয়ার' (১৯৬৯/১৩৭৬) [এটি তাঁর তৃতীয় প্রকাশিত উপন্যাস।]
৪) 'তুলনাহীনা' (১৯৭৪/১৩৮১) [এটি তাঁর শেষ প্রকাশিত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের পটভূমিতে রচিত। এটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত উপন্যাস। চরিত্র : নায়ক --- 'কীর্তি চৌধুরী' এবং নায়িকা --- 'শিপ্রা রায়'।
♣¤ গল্প-সংকলন গ্রন্থ :-
১) 'শ্রেষ্ঠ গল্প' (১৯৬১/১৩৬৮)
২) 'বহু বিচিত্র' (১৯৬২/১৩৬৯)
৩) 'হাস্য-মধুর' (১৯৬৬/১৩৭৩)
৪) 'পছন্দসই' (১৯৬৭/১৩৭৪)
৫) 'রাজা-উজির' (১৯৬৯/১৩৭৬)
♥¤ ছোটো গল্পগ্রন্থ :-
১) 'চাচা কাহিনী' (১৯৫২/১৩৫৯) : এই গল্পগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'কোলকাতা নিউ এজ পাবলিশার্স' থেকে। উৎসর্গ করেন -স্ত্রী রাবিয়া খাতুনকে। এই গল্পগ্রন্থে মোট ১১ টি রম্য গল্প আছে। সেগুলি হল :- 'স্বয়ংবরা', 'কর্নেল', 'মা-জননী', 'তীর্থহীনা', 'বেলতলাতে দু-বার', 'ক্যাফে-দে-জেনি', 'বিধবা বিবাহ', 'রাক্ষসী', 'পাদটীকা', 'পুনশ্চ', 'বেঁচে থাকো সর্দিকাশি'। এর মধ্যে 'স্বয়ংবরা', 'কর্নেল', 'মা-জননী', 'তীর্থহীনা', 'বেলতলাতে দু-বার', 'বেঁচে থাকো সর্দিকাশি' - এই ছ'টি রম্য গল্পের পটভূমি জার্মানী। 'ক্যাফে-দে-জেনি', 'বিধবা বিবাহ', 'রাক্ষসী' - এই তিনটি রম্য গল্পের পটভূমি ভারত। আর 'পাদটীকা', 'পুনশ্চ' - এই দু'টি রম্য গল্পের পটভূমি ফ্রান্স। চরিত্র --- 'সূর্য্য রায়', 'পুলিন সরকার', 'গোঁসাই', 'শ্রীধর ভট্টাচার্য', 'গোলাম মৌলা' প্রমুখ। এর শ্রেষ্ঠ গল্প --- 'কর্ণেল'। নাৎসীবাদের নগ্নরূপ চিত্রিত হয়েছে --- 'বেলতলাতে দু-বার' গল্পে। এই গল্পগ্রন্থটি তিনি স্ত্রী রাবিয়া খাতুনকে উৎসর্গ করেন।
[এটি একটি রম্যরচনা মূলক গ্রন্থ।]
২) 'টুনি মেম' (১৯৬৪ /১৩৭০) : এই গল্পগ্রন্থের দুটি অংশ। (ক) 'টুনি মেম' এবং (খ) 'শেষ চিন্তা'। প্রথম অংশ 'টুনিমেম'তে দুটি গল্প রয়েছে --- 'লেখকের জীবনী' এবং 'একটি নাটকের অনুবাদ'। দ্বিতীয় অংশ 'শেষ চিন্তা'তে রয়েছে ধর্ম-সাহিত্য-রাজনীতি বিষয়ক আলোচনা।
♥¤ প্রবন্ধগ্রন্থ :-
১) 'পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' (১৯৫৬/১৩৬৩)
২) 'চতুরঙ্গ' (১৯৬০/১৩৬৭)। এই প্রবন্ধগ্রন্থের প্রধান প্রবন্ধগুলি হল --- 'শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস', 'রবি-পুরাণ', 'দিল্লী স্থাপত্য', 'হরিনাথ দে স্মরণে'।
৩) 'বড়বাবু' (১৯৬৬/১৩৭২)। 'বড়বাবু' হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ আছে এই প্রবন্ধগ্রন্থটিতে। এছাড়াও এই প্রবন্ধগ্রন্থের আরও কয়েকটি প্রধান প্রবন্ধ হল ---'রবীন্দ্রনাথ', 'নেতাজী', 'সরলাবালা', 'রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়', 'বঙ্গে মুসলিম সংস্কৃতি', 'হিটলারের পরিচয়' ইত্যাদি।
৪) 'হিটলার' (১৯৭০/১৩৭৭)
৫) 'কত না অশ্রুজল' (১৯৭১/১৩৭৮)
৬) 'বিদেশে' (১৯৭১) [এই প্রবন্ধগ্রন্থটি 'পঞ্চতন্ত্র' শিরোনামে 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে।]
৭) 'বাংলাদেশ ও উভয়বাংলা' (১৯৭২) [এই প্রবন্ধগ্রন্থটি 'পঞ্চতন্ত্র' শিরোনামে 'দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে।]
৮) 'পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়' (১৯৭৬/১৩৮২) [এটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ।]
৯) 'গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন' (১৩৮৮) [এটি একটি রবীন্দ্রজীবনী বিষয়ক গ্রন্থ। এটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ]
♥¤ ভ্রমণ কাহিনী :-
১) 'দেশে বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) [এই ভ্রমণ কাহিনীটি আফগানিস্তানের কাবুল শহরের কাহিনী নিয়ে রচিত। সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশীর মতে, এই ভ্রমণ কাহিনীটি সৈয়দ মুজতবা আলীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।]
২) 'জলে ডাঙ্গায়' (১৯৫৬/১৩৬৩)
৩) 'মুসাফির' (১৯৭১/১৩৭৮) [এই ভ্রমণ কাহিনীর তিনটি অংশ। (ক) 'মুসাফির', (খ) 'ক্রেতা' ও (গ) 'দ্বীপের'।
♥¤ রম্যরচনা :-
১) 'ময়ূরকণ্ঠী' (১৯৫২/১৩৫৯)। এই রম্যগ্রন্থটির প্রধান রম্যগল্পগুলি হল --- 'রামমোহন রায়', 'গুরুদেব', 'শিক্ষা-সংস্কার', 'বিশ্বভারতী', 'ফরাসী-জার্মান'।
২) 'পঞ্চতন্ত্র' (১ম পর্ব, ১৯৫২/১৩৫৯) [এই রম্যরচনাটি তিনি উৎসর্গ করেন সরলাবালা সরকারকে।]
৩) 'ধূপছায়া' (১৯৫৭/১৩৬৪)। এই রম্যগ্রন্থটির প্রধান রম্যগল্পগুলি হল --- 'রসগোল্লা', 'বাঙালী', 'দেয়ালি', 'বাঁশবনে', 'ভাষার জমা খরচ', 'শিক্ষা প্রসঙ্গে'।
৪) 'দ্বন্দ্ব মধুর' (১৯৫৮/১৩৬৫)
৫) 'ভবঘুরে ও অন্যান্য' (১৯৬২/১৩৬৯)। এই রম্যগ্রন্থটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতিমোহন সেন, শান্তিনিকেতন, ডি. এইচ. লরেন্স-কে নিয়ে রচিত হয়েছে নানা রচনা। এই রম্যগ্রন্থটির প্রধান রম্যগল্পগুলি হল --- 'বঙ্গের বাইরে বাঙালি', 'বাংলাদেশ', 'নিরলঙ্কার'।
৬) 'শ্রেষ্ঠ রম্যরচনা' (১৯৬২/১৩৬৯) [এটি একটি সংকলন গ্রন্থ]
৭) 'দু-হারা' (১৯৬৬/১৩৭২)। এই রম্যগ্রন্থটির প্রধান রম্যগল্পগুলি হল --- 'মদ্যপন্থা ওরফে মধ্য পন্থা', 'প্রেমের প্রথমভাগ', 'অদৃষ্টের রঙ্গরস', 'আধুনিকের আত্মহত্যা'।
৮) 'পঞ্চতন্ত্র' (২য় পর্ব, ১৯৬৬/১৩৭৩)
৯) 'হাস্য-মধুর' (১৯৬৬/১৩৭৩) [এটি একটি সংকলন গ্রন্থ]
♠¤ গল্পমালা :-
১) 'স্বয়ংবরা'
২) 'কর্নেল'
৩) 'মা-জননী'
৪) 'তীর্থহীনা'
৫) 'বেলতলাতে দু-বার'
৬) 'ক্যাফে-দে-জেনি'
৭) 'বিধবা বিবাহ'
৮) 'রাক্ষসী'
৯) 'পাদটীকা'
১০) 'পুনশ্চ'
১১) 'বেঁচে থাকো সর্দিকাশি'
১২) 'রস-গোল্লা' [এটি একটি ইংরেজি গল্পমালা।]
♠¤ অনুবাদ গ্রন্থ :-
১) 'প্রেম' (১৯৬৫/১৩৭২)
♠¤ ইংরেজি গ্রন্থ :-
১) 'The Origin of Khojahs and Their Religious Life Today' (১৯৩৬) [এই গ্রন্থটি ডি. ফিল অধিসন্দর্ভ বন থেকে প্রকাশিত হয়।]
♠¤ সম্পাদিত পত্রিকা :-
১) 'তাফাফাৎ-উল-হিন্দ'
২) 'সাকায়-তুল-হিন্দ'
♦¤ উৎসর্গীকৃত গ্রন্থসমূহ :-
১) 'চাচাকাহিনি' (১৯৫২/১৩৫৯) গল্পগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন --- স্ত্রী রাবিয়া খাতুনকে।
২) 'পঞ্চতন্ত্র' (১ম পর্ব, ১৯৫২/১৩৫৯) রম্যরচনাটি তিনি উৎসর্গ করেন --- সরলাবালা সরকারকে।
♦¤ অসামান্য খ্যাতির পূজারী :-
সৈয়দ মুজতবা আলী সামগ্রিকভাবে উভয় বঙ্গে সমান জনপ্রিয় ও সমাদৃত লেখক ছিলেন। আন্তর্জাতিক চেতনায় সমৃদ্ধ এই লেখকের বিশ্বমানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং অননুকরণীয় রচনাশৈলী তাঁকে এই সম্মানের অধিকারী করেছে। তদুপরি তিনি যে নৈপুণ্যের সঙ্গে বিদেশি চরিত্র ও আবহ বাংলা সাহিত্যে এনেছেন তাও তুলনাহীন। হালকা মেজাজে আড্ডার ঢঙে বলে গেলেও তাঁর অধিকাংশ রচনা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, শাস্ত্রচর্চা ও বিচার-সমালোচনায় পরিপূর্ণ।
♦তাঁর বিভিন্ন গ্রন্থ সম্পর্কিত তথ্যাদি :-
সৈয়দ মুজতবা আলী 'দেশে বিদেশে' গ্রন্থের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে প্রথম প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। 'দেশে বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) গ্রন্থখানি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পাঠকচিত্ত জয় করতে সক্ষম হন। আফগানিস্তানের কাবুল শহরে অবস্থানের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও অন্তরঙ্গ উপলব্ধির ফসল এই গ্রন্থখানি। তিনি বহুদেশ ভ্রমণ করেছেন, কর্মক্ষেত্রের পরিবর্তন করেছেন এবং বহুজনের সান্নিধ্য লাভ করেছেন। তাই তাঁর লেখায় অনুরূপ বহুদর্শিতা ও নিবিড় অনুধ্যানের প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর রম্যরচনাবিষয়ক ছোটো ছোটো রচনা পাঠকদের চিত্তবিনোদন ও অনাবিল আনন্দদানে সমর্থ হয়েছে। আবার এ কথাও ঠিক যে, তিনি হাসির আবরণে অনেক সময় হৃদয়ের গভীরতর সত্যকে উদঘাটন ও প্রকাশ করেছেন। তিনি জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে বিবিধ ভাষা ও শাস্ত্র থেকে এসব উপাদান আহরণ করেন। বিশেষ করে উপন্যাস ও ছোটোগল্পে মানবজীবনের অন্তহীন দুঃখ-বেদনা ও অপূর্ণতার কথা তিনি সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন।
♦¤ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি :-
১) তাঁদের আদি নিবাস ছিল শ্রীহট্টের (সিলেট) করিমগঞ্জে।
২)তাঁর পৈতৃক ভিটা ছিল সিলেটের (শ্রীহট্টের) মৌলভীবাজারের হবিগঞ্জে।
৩) তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'দেশে বিদেশে', 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫৬ বঙ্গাব্দ)।
৪) প্রমথনাথ বিশীর মতে, 'দেশে বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) ভ্রমণ কাহিনীটি সৈয়দ মুজতবা আলীর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ।
৫) তাঁর 'দেশে বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) ভ্রমণ কাহিনীটি আফগানিস্তানের কাবুল শহরের কাহিনী নিয়ে রচিত।
৬) 'অবিশ্বাস্য' (১৯৫৪/১৩৬১) হল তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।
৭) 'শবনম' (১৯৬০/১৩৬৭) হল তাঁর দ্বিতীয় প্রকাশিত উপন্যাস। এটি 'দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৮) 'শহর-ইয়ার' (১৯৬৯/১৩৭৬) হল তাঁর তৃতীয় প্রকাশিত উপন্যাস।
৯) 'তুলনাহীনা' (১৯৭৪/১৩৮১) হল তাঁর শেষ প্রকাশিত উপন্যাস। এই উপন্যাসটি ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের পটভূমিতে রচিত। এটি তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত উপন্যাস। চরিত্র : নায়ক --- 'কীর্তি চৌধুরী' এবং নায়িকা --- 'শিপ্রা রায়'।
১০) তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'The Origin of Khojahs and Their Religious Life Today'।
১১) ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত হন।
১২) বীরভূমের শান্তিনিকেতন থেকে প্রথমে 'স্নাতক' হয়ে বের হন। পরবর্তীতে ম্যাট্রিক লেশন পাস করেন।
১৩) বিশ্বভারতীর প্রথম স্নাতক ছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী এবং বাচ্চু ভাই শুক্লা।
১৪) জার্মানি থেকে তিনি 'হুমবল্ট' উপাধি লাভ করেন। ১৯২৯ সালে ‘হুমবল্ট’ বৃত্তি নিয়ে তিনি জার্মানি গিয়ে বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন।
১৫) 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় 'রায়পিথৌরা' ছদ্মনামে তিনি 'সপ্তপর্ণী' কলামের সূচনা করেন। এছাড়াও তিনি 'গোলাম মৌলা' ছদ্মনামেও লিখতেন।
১৬) পরবর্তীতে টেকচাঁদ রায়', 'গোলাম মৌলা', 'রায়পিথৌরা', ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘প্রিয়দর্শী’, 'মুসাফির' ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায়, যেমন :- 'আনন্দবাজার', 'দেশ', 'সত্যযুগ', 'শনিবারের চিঠি', 'বসুমতী', 'হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড' প্রভৃতি পত্র-পত্রিকায় তিনি কলাম লিখতেন। এছাড়াও 'মোহাম্মদী', 'চতুরঙ্গ', 'মাতৃভূমি', 'কালান্তর', 'আল-ইসলাহ্' প্রভৃতি সাময়িক পত্রেরও তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন।
১৭) সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রিয় বিষয় ছিল তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব।
১৮) বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট।
১৯) তিনি 'তাফাফাৎ-উল-হিন্দ' ও 'সাকায়-তুল-হিন্দ' নামক আরবি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
২০) বরোদার মহারাজা সরাজীরাও গায়কোয়াড-এর আমন্ত্রণে তিনি বরোদায় যান অধ্যাপনার কাজে।
২১) তাঁর লেখার ভাষাকে স্যার চার্লস ল্যাম্বের ভাষার সঙ্গে তুলনা করা হয়।
২২) অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ফরমিকির অধীনে তিনি সংস্কৃত ভাষা, সাংখ্য ও বেদান্ত অধ্যয়ন করেন। ড.মার্ক কলিন্স ও মরিসের নিকট ইংরেজি, ফরাসি ও জার্মান, বগদানফের নিকট ফারসি ও আরবি এবং তুচ্চির নিকট ইতালিয়ান ভাষা শেখেন। এ সময় তিনি হিন্দি ও গুজরাটি ভাষাও শেখেন। বাল্যকালে পারিবারিক সূত্রে উর্দুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে।
২৩) বাংলা ভাষা ছাড়াও ফারসি, জার্মান, আরবি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, সংস্কৃত, মারাঠী, গুজরাটী, ইতালিয়ান প্রভৃতি ভাষাসহ তিনি মোট ১৫টি ভাষা বলতে, লিখতে ও পড়তে পারতেন।
২৪) তাঁর রচিত বইয়ের সংখ্যা হল ৩০টি।
২৫) সৈয়দ মুজতবা আলীর সার্থক দুটি ভ্রমণ কাহিনী হল --- 'দেশ বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) ও 'জলেডাঙ্গায়' (১৯৫৬/১৩৬৩)।
২৬) 'চাচাকাহিনি' (১৯৫২/১৩৫৯) গল্পগ্রন্থটি তিনি উৎসর্গ করেন --- স্ত্রী রাবিয়া খাতুনকে।
২৭) 'পঞ্চতন্ত্র' (১ম পর্ব, ১৯৫২/১৩৫৯) রম্যরচনাটি তিনি উৎসর্গ করেন --- সরলাবালা সরকারকে।
২৮) সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনাদর্শে গড়া।
♣¤ মৃত্যুর পর প্রকাশিত গ্রন্থাবলী :-
১) 'তুলনাহীনা' (১৯৭৪/১৩৮১) উপন্যাস
২) 'পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয়' (১৯৭৬/১৩৮২) প্রবন্ধগ্রন্থ
৩) 'গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন' (১৩৮৮) প্রবন্ধগ্রন্থ
♣¤ তাঁর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :-
১) সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশী তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, --- "নতুন পথপ্রদর্শক হিসাবে মুজতবাই শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্রদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক।"
২) সাহিত্যিক গজেন্দ্রকুমার মিত্র তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, --- "তিনি মজলিসী গল্প বলতেন... এ ধরনের গল্পে তিনিই স্রষ্টা।"
৩) সাহিত্যিক হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, --- "তিনি যা ভাবেন তা পুরোপুরি পাঠককে দিতে পারেন। ঠিক এই মুহূর্তের মুজতবা সাহেব বোধকরি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক।"
♣¤ তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য :-
১) তিনি সাহিত্যিক সতীনাথ ভাদুড়ীকে 'লেখকের লেখক' বলে অভিহিত করেছেন।
♣¤ কয়েকটি বিখ্যাত উক্তি :- ১) "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না।" --- তিনি এই কথাটি তাঁর "বই কেনা" প্রবন্ধে বলেছেন। ২) "ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাতদিনে না খেলে এক সপ্তায়।"
♥¤ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা :-
১) 'দেশে বিদেশে' (১৯৪৯/১৩৫৬) ভ্রমণ কাহিনীর জন্য দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে 'নরসিংহ দাশ পুরস্কার' প্রদান করেন।
২) সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে 'আনন্দ পুরস্কার' প্রদান করা হয়।
৩) সাহিত্যক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখায় বাংলাদেশ সরকার ২০০৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর 'একুশে পদকে' ভূষিত করেন।
৪) 'আনন্দবাজার পত্রিকা' কর্তৃক তিনি 'সুরেশচন্দ্র মজুমদার' পুরস্কার লাভ করেন।
♥¤ মৃত্যু ও মৃত্যুস্থান :-
১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার কলকাতার পিজি (বর্তমানে এস.এস.কে.এম) হাসপাতালের ১২৭ নং কক্ষে সৈয়দ মুজতবা আলী মৃত্যুবরণ করেন।
♥¤ তথ্যঋণ :-
১) 'আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' --- অধ্যাপক শ্রীতপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
২) 'সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী', দশম খণ্ড (অগ্রহায়ণ ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ) --- মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনী। ৩) 'উইকিপিডিয়া' (Wikipedia)।
৪) 'বাংলাপিডিয়া' (Banglapedia)।
No comments