Breaking News

মৎস্যোৎপাদনে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সফলতা

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) গবেষণা পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ৫৭টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ৪৬টি মাছের প্রজনন, জীনপুল সংরক্ষণ, জাত-উন্নয়ন ও চাষাবাদবিষয়ক এবং অপর ১১টি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক। মাঠপর্যায়ে এসব প্রযুক্তি সম্প্রসারণের ফলে মাছের উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৬ কোটি জনগণের দৈনিক মাথাপিছু ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে তারা এখন ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ গ্রহণ করছে। 
২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাছের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪০ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন; কিন্তু উৎপাদিত হয়েছে ৪১ লাখ ৩৪ মেট্রিক টন। শুধু তা-ই নয়, এর ফলে দেশে গ্রামীণ কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। স্বাদু পানির ২৬০টি মৎস্য প্রজাতির মধ্যে ৬৪টি প্রজাতি বর্তমানে বিপন্ন হলেও এ সময় কৃত্রিম ও নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে ট্যাংরা, গুজি আইড়, চিতল, ফলি, কুঁচিয়া মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা এসেছে। এ পর্যন্ত বিলুপ্তপ্রায় ১৬টি মাছকে পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি দেশের মাছ উৎপাদনে ব্যাপক আবদান রেখে চলেছে। পুনরুদ্ধারকৃত মাছের চাষাবাদ সম্প্রসারিত হওয়ায় বাজারে এদের প্রাপ্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মূল্য জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এসেছে। বিলুপ্তপ্রায় টেংরা মাছের (Mystus vittatus) প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য এ প্রতিষ্ঠান যেমন ২০১৭ সালের জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে রৌপ্যপদক লাভ করে, তেমনি বিলুপ্তপ্রায় ১৬টি মৎস্য পুনরুদ্ধার এবং দেশের মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখায় সম্প্রতি ২০১৮ সালের সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট ‘কেআইবি কৃষিপদক’ প্রদান করেছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (BFRI) মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে দেশের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান। সদর দপ্তর ময়মনসিংহে অবস্থিত। এর গবেষণা কার্যক্রম দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত পাঁচটি কেন্দ্র ও পাঁচটি উপকেন্দ্র থেকে পরিচালিত হয়ে থাকে। গবেষণা কেন্দ্রগুলো হচ্ছে ময়মনসিংহের স্বাদু পানিকেন্দ্র, চাঁদপুরের নদীকেন্দ্র, খুলনাধীন পাইকগাছার লোনাপানিকেন্দ্র, কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্র এবং বাগেরহাটের চিংড়ি গবেষণাকেন্দ্র। উপকেন্দ্র পাঁচটি হচ্ছে রাঙ্গামাটির নদী উপকেন্দ্র, বগুড়ার সান্তাহারের প্লাবনভূমি উপকেন্দ্র, যশোরের স্বাদুপানি উপকেন্দ্র, পটুয়াখালীর খেপুপাড়ার নদী উপকেন্দ্র এবং নীলফামারীর সৈয়দপুরের স্বাদু পানি উপকেন্দ্র। বিজ্ঞানীরা জেনেটিক গবেষণার মাধ্যমে ২০০৯ সালে দেশীয় রুই মাছের নতুন উন্নত জাত উদ্ভাবনে সক্ষম হয়েছেন। বিভিন্ন নদী-উৎস থেকে রুই মাছের বন্যজাত সংগ্রহ করে ক্রসব্রিডিং পদ্ধতিতে উদ্ভাবিত প্রথম প্রজন্মের উন্নতজাতের এ রুই বিদ্যমান জাত থেকে ১৬ গুণ অধিক উৎপাদনশীল। ফলে এ মাছের উদ্ভাবিত জাতটি ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হলে দেশে অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া সম্ভব হবে। এ জাতটি উদ্ভাবনের জন্যও ইনস্টিটিউটকে ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০১০’ স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। এ দেশে দুর্লভ প্রজাতির কুঁচিয়া মাছ অত্যন্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ ও ঔষধি গুণসম্পন্ন। দেশে এর চাহিদা তেমন না থাকলেও আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক বাজারে কুঁচিয়ার চাহিদা থাকায় ২০১৫ সালে নিয়ন্ত্রিত প্রজননের মাধ্যমে কুঁচিয়ার পোনা-উৎপাদনে সফলতা এসেছে। এ পোনা উৎপাদনের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে নির্বিচারে কুঁচিয়ার আহরণ হ্রাস পেয়েছে এবং চাষাবাদ সহজতর হয়েছে। অত্যন্ত সুস্বাদু কৈ মাছের দেশীয় প্রজাতির পাশাপাশি দেশে ভিয়েতনামি কৈ মাছের চাষ ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অধিক মুনাফালোভী কতিপয় চাষি অধিক ঘনত্বে (৩-৫ হাজার/শতক) কৈ মাছ পুকুরে চাষ করে। ফলে পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে কৈ মাছের ব্যাপক মড়ক দেখা দিলে ২০১৪ সাল থেকে পরিচালিত গবেষণায় কৈ মাছের মড়কের কারণ হিসেবে Streptococicus agalactiae নামক ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করা হয়েছে। এ জীবাণু দমনে ইনস্টিটিউট এরই মধ্যে প্রতিরোধক ভ্যাকসিনও তৈরি করেছে। উদ্ভাবিত কৈ মাছের ভ্যাকসিন বিশ্বে এটাই প্রথম। মিঠাপানির ঝিনুক(Lamellidens marginalis Ges L. corrianus) থেকে ইমেজমুক্তা তৈরির কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৭-৮ মাসেই ঝিনুক থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ ইমেজমুক্তা তৈরি করা সম্ভব। সাধারণত মোম, খোলস, প্লাস্টিক, স্টিল ইত্যাদি দিয়ে চাহিদামাফিক তৈরীকৃত নকশাকে ঝিনুকের ম্যান্টাল টিস্যুর নিচে স্থাপন করে ইমেজমুক্তা তৈরি করা হয়। ২০১৬ সালে বিদেশ থেকে সংগৃহীত বড় আকৃতির মুক্তা উৎপাদনকারী ঝিনুকও পুকুরে লালনপালনসহ প্রজননের মাধ্যমে এর পোনা উৎপাদনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি ও সংরক্ষণে অভয়াশ্রম স্থাপনের উদ্দেশ্যে চাঁদপুরের নদীকেন্দ্র থেকে পাঁচ বছর ধারাবাহিক গবেষণা পরিচালনা এবং গবেষণায় নদীতে জাটকার প্রাচুর্যতা, পানির গুণাগুণ ও পানির প্ল্যাংটনের (খাদ্যকণা) প্রাচুর্যতার ভিত্তিতে ষষ্ঠ অভয়াশ্রম চিহ্নিত করা হয়েছে। ইলিশ/জাটকার ষষ্ঠ অভয়াশ্রম বাস্তবায়ন করা গেলে বছরে প্রায় ৪ হাজার ৩০০ কোটি অতিরিক্ত জাটকা ইলিশ উৎপাদন হবে বলে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন। ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা খুলনা জেলার পাইকগাছার লোনাপানিকেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে নোনা ট্যাংরা ও পারশে মাছের ব্যাপক পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছে। নোনা ট্যাংরা মাছের এ প্রজনন কৌশল উদ্ভাবনের জন্য ইনস্টিটিউটটি জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০০৯ স্বর্ণপদক লাভ করে। প্রাকৃতিক পরিবেশে জোয়ারভাটা-বিধৌত প্যারাবনসমৃদ্ধ মোহনা এলাকা কাঁকড়ার আবাসস্থল। ডিম ও পোনা ছাড়ার জন্য পরিপক্ব স্ত্রী কাঁকড়া গভীর সমুদ্রে পরিভ্রমণ করে বলে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনের জন্য ডিম বহনকারী বা মা কাঁকড়া পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ফলে পাইকগাছার লোনাপানিকেন্দ্রে পর্যায়ক্রমিক গবেষণার মাধ্যমে এ পরিপক্ব মা (মৎধারফ) কাঁকড়া থেকে প্রজনন উপযোগী ডিম বহনকারী (নবৎৎরবফ) মা কাঁকড়া উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ শুঁটকি তৈরির লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের কক্সবাজারের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তিকেন্দ্র সময়সাশ্রয়ী এবং দীর্ঘদিন ব্যবহারোপযোগী ‘বিএফআরআই মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার’ উদ্ভাবিত করেছে। ড্রায়ারটিতে সৌর ও বিদ্যুৎশক্তি উভয়ই ব্যবহার করা যায়। ফিশ ড্রায়ারের মূল কাঠামো মেটালিক, যা জিআই পাইপ/অ্যাংগেল বা এসএস-বার দ্বারা তৈরি। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, পুষ্টির চাহিদা পূরণ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য বর্তমান মৎস্যবান্ধব সরকারের আমলে ৮ বছরে ইনস্টিটিউটে সাতটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে এবং তিনটি উন্নয়ন প্রকল্প বর্তমানে চলমান রয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে ১৬ কোটি জনগণের চাহিদা পূরণ করার পর অতিরিক্ত মৎস্য উৎপাদনেও সফলতা দেখিয়েছে। আমরা বহু বছর পর হারিয়ে যাওয়া ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটিকে আবার পুনরুদ্ধার ও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছি।

No comments