নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা হত্যার অজানা দিক এবং অবহেলিত সিরাজউদ্দৌলা আর যত্নে আছে মীর জাফরের কবর
বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করা হয় জুলাই মাসের প্রথম দিকে। তবে এই হত্যার দিন তারিখ নিয়ে মতভেদ আছে। অনুমান করা হয়, হত্যাকা-ের প্রকৃত তারিখ আড়াল করার জন্যই সিরাজের বিরুদ্ধ পক্ষ নানা অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। ইংরেজ কূটনৈতিক এবং পলাশী যুদ্ধে উপস্থিত লুক স্ক্রাপটন নবাব সিরাজের মৃত্যু ৪ তারিখে বলে উল্লেখ করে গেছেন। অন্যরা বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক সলিমুল্লাহ খানের লেখা ‘সত্য সদ্দাম হোসেন এবংসিরাজ-উদ-দৌলা যারা পাঠ করেছেন, তারা বেশ ভালোভাবেই জ্ঞাত আছেন নবাব সিরাজের প্রকৃত মৃত্যু তারিখ কতখানি বিভ্রান্তিকর। তবে লর্ড ক্লাইভ কিন্তু একটা অকাট্য সত্য উচ্চারণ করেছেন। ওই গ্রন্থে উদ্ধৃত তার এক চিঠিতে তিনি বলেছেন, নবাব সিরাজকে মুর্শিদাবাদে আনার সাথে সাথেই হত্যা করা হয়।
তিনি সেই সময় মুর্শিদাবাদ থেকে সামান্য দূরে মোরাদাবাদে অবস্থান করছিলেন। সকাল বেলা মীরজাফর সেখানে এসে ক্লাইভকে জানান, সিরাজ-উদ-দৌলা বেঁচে নেই। ক্লাইভের ঘনিষ্ঠ বন্ধু উর্মিও কিছু কম জানতেন না। উর্মি মীর জাফরের সেই রাতের সভায় উপস্থিত ছিলেন। তা না হলে কীভাবে তিনি লিখলেন, নিশিথ রাতে দস্যু ও তস্করের ন্যায় শৃঙ্খলিত অবস্থায় সিরাজ-উদ-দৌলাকে মীরজাফরের সামনে উপনীত করা হইল। উর্মি এও লিখেছেন, ওই সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সিরাজ-উদ-দৌলাকে মেরে ফেলা হবে। অনেকে মনে করতে পারেন সিরাজকে মুর্শিদাবাদে আনার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর হত্যা করা হয়। আসলে এ ধারণা সম্ভবত সঠিক নয়। অনেক আগে সেটা অবিনশ্বর রাম চক্রবর্তীর ‘বেজগাঁ’ ইতিকথা যারা পাঠ করেছেন এমন পাঠকদের মতে, মীর জাফরের সেই সভায় উপস্থিত করা হয় সিরাজকে চ্যাংদোলা অবস্থায়। তখন বিধ্বস্ত নবাবের নাকে-মুখে ছিল কালি মাখানো। ধারণা করা হয়, এর পরই বন্দি নবাবকে পূর্বতীরে মিরণের প্রাসাদে দ্রুত পাঠানো হয় এবং হত্যা করা হয়। কিন্তু ‘বেজগাঁ’ পাঠকরা বলেন, পরের দিন সকাল ৯-১০টার দিকে ভাগিরথীর পূর্বতীরে একটি গাছের ডালে মৃত সিরাজকে ঝুলানো হয়।
কালোবর্ণের মাস্তান গোছের লুক স্ক্রাফটনের নির্দেশে একজন সিরাজের মাথায় গুলি করে। ডাক্তার ফোর্থ সিরাজের পায়ের রগ কেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করেন। লেখকের ভাষায়, এটা ছিল সিরাজের দ্বিতীয় মৃত্যু। সিরাজের মৃত্যু তারিখ নিয়ে জটিলতার একটি কারণ রয়েছে। সিরাজকে সন্ধ্যায় মুর্শিদাবাদে আনার কথা ছিল। কিন্তু সিরাজ পক্ষের ভয়ে অত্যন্ত গোপনে গভীর রাতে, সম্ভবত রাত ১১টার দিকে সিরাজকে মীরজাফরের সামনে উপস্থিত করা হয়। এর পরই অনুমান করা হয় ১২টার পর তাকে হত্যা করা হয়। সিরাজের মৃত্যু ২/৩ তারিখ নিয়ে তাই এত বিতর্ক। সোজা কথায় বলতে গেলে, ২ তারিখ গভীর রাতে নবাব মুর্শিদাবাদে আনা হয় এবং এর পরই তাকে হত্যা করা হয়।
সিরাজকে মুর্শিদাবাদে আনা এবং হত্যা দুটোই ২ এবং ৩ তারিখের মধ্যে ছিল। সিরাজকে মোহাম্মদী বেগ না অন্য কেউ হত্যা করেছে এ নিয়ে আজ প্রশ্ন উঠেছে। ওঠার কারণও আছে। বৃটিশেরা এমন কৌশলে ইতিহাস লিখিয়েছে যেখানে একটা ধোঁয়াশা বিদ্যমান। সিরাজকে মোহম্মদী বেগ হত্যা করে, এটা একজন মাত্র লেখক স্বীকার করেছেন। অন্যরা ওই লেখকের মতই সমর্থন করেছেন।
মোহাম্মদী বেগ সিরাজকে হত্যা করেছিলেন এটা নিয়েও আছে। খোদ মুর্শিদাবাদের অধিবাসী এবং নবাব পরিবারের ওপর বহু প্রবন্ধের লেখক কালিপদ দাশ বলেন, নবাব সিরাজকে বন্দিঘরের কুলঙ্গি দিয়ে বন্দুক দিয়ে ইংরেজরা গুলি করে হত্যা করে।
এসব তথ্যের আলোকে বলতে পারি, সিরাজের হত্যাকা- ছিল রহস্যে ভরা। নবাব সিরাজের মৃত্যুর ২৫৯ বছর পর এখনো অনেকেই আমরা বিশ্বাস করি মোহাম্মদী বেগের হাতে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু এটা কতখানি সত্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। কার দোষ কার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সিরাজ হত্যা নাটক তৈরি হয়েছিল হয়তো একদিন তার প্রকৃত ইতিহাসও বের হয়ে আসবে। যেমন বের হয়ে এসেছে মীরজাফরের সেই রাতের সভায় উর্মির উপস্থিতি। যেমন সম্প্রতি বের হয়ে এসেছে পলাশিতে ইংরেজ কর্তৃক শত শত নিরস্ত্র মানুষ হত্যা এবং এদের রক্তে পলাশী সবুজ মাঠ লাল হয়ে পাওয়ার কথা। লেখকের ভাষায়, এ সংখ্যা হাজার হাজার। এ ঘটনা একজন মাত্র ইংরেজ লেখক স্বীকার করেছেন। যা আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া ‘নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা’ গ্রন্থে সামান্য হলেও উল্লেখ করেছেন। সলিমুল্লাহ এবং যাকারিয়ার গ্রন্থ সাম্প্রতিক রচনা।
সিরাজ হত্যার আরও নানা কারুণ দৃশ্য রয়েছে বিভিন্ন ঐতিহাসিকের গ্রন্থে। সেসব বই এখন সম্পূর্ণ বাজারশূন্য। ‘বেজগাঁ’ ইতিকথায় এমন তথ্যও নাকি রয়েছে, সিরাজের দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে মাথাসহ একটি ব্যাগে ভরে সিরাজ মাতা আমিনার সামনে উপস্থিত করা হয়েছিল। তিনি ব্যাগ খুলে দেখেন তার প্রিয় পুত্রের কাটা মাথা, চোখ খোলা অবস্থায় তার দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের বুক তখন হাহাকার করে ওঠে। আসলে সিরাজ হত্যা নিয়ে তৎকালীন ঐতিহাসিকরা এমন ধূ¤্রজাল তৈরি করেছিলেন যার রহস্য হয় তো আরও বহুকাল থাকবে।
তৎকালীন সময়ে পলাশী যুদ্ধ নিয়ে যেসব গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, এর সব লেখকই ছিলেন বৃটিশদের চাকরিপুষ্ট এবং পদলেহনকারী। পলাশী ষড়যন্ত্রে যাতে কোনোভাবেই ইংরেজদের দায়ী না করা যায় একথা মাথায় রেখে গ্রন্থগুলো রচনা করা হয়েছিল, যা পাঠ করলেই বোঝা যায়। আমরা আশা করি, প্রকৃত ইতিহাস গবেষকের হাত একদিন বেরিয়ে আসবে নবাব সিরাজ হত্যার প্রকৃত তারিখ, তার হত্যাকারীর প্রকৃত নামধাম এবং পলাশী সংক্রান্ত আরও বহু ঘটনা ।
No comments