Breaking News

চোরাবালি

কাল রাত্তিরে আবার হয়েছে। বাপি আর মাম্‌মামের ঝগড়া।
ঝগড়ার সময় বাপি মাম্‌মাম দুজনেই বেশির ভাগ টানা ইংলিশ বলে। প্রথম-প্রথম যখন ওদের ঝগড়া শুনতাম, সবটুকু বুঝতে পারতাম না। বেঙ্গলিতে যতটুকু বলত তা থেকে আন্দাজ পাওয়া যেত একটুখানি। বাপি বেশি-বেশি ড্রিংক করে বলে মাম্‌মামের রাগ। সেই দিয়ে শুরু হত।
তখন আমি সবে বাড়ির মিস্‌-এর কাছে ওয়ার্ডবুক শুরু করেছি। পরের বছর আমাকে সেন্ট নিকোলাসে দেবে, বলে রেখেছিল বাপি। সেন্ট নিকোলাস খুব বড় স্কুল। বেঙ্গলি বললেই পানিশমেন্ট। ওখানকার অ্যাডমিশন টেস্ট নাকি খুব টাফ, তাই মিস আমাকে রোজ ওয়ার্ডবুক ক্র্যাম করাত। না পারলেই হাতের তালুতে স্কেল দিয়ে চড়াৎ! আর আমি ভেউ ভেউ করে কাঁদতাম। সেই নিয়েও রাতে ফের ঝগড়া হত ওদের। মাম্‌মাম মিস্‌কে ছাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলত। আর বাপি বোধহয় মাম্‌মামকে ব্লেম করত, বলত— মাম্‌মাম আমার পড়া দেখে না বলেই তো বাইরের লোক রাখতে হয়েছে!
আমি বিছানার এক কোণে মটকা মেরে ঘুমের অ্যাকটিং করতাম আর সব শুনতাম। ভাবতাম, কার দিকটা সাপোর্ট করি! মিস্‌ যে আমাকে পেটায় মাম্‌মাম সেটার অ্যান্টি করছে, তাই মাম্‌মামকেই ভালো মনে হত। আবার বাপি যখন বলছে মাম্‌মামই এর জন্যে রেসপনসিবল— তখন সেটাও যে একদম ভুল, তা বলতে পারতাম না। পার্কে যাদের সঙ্গে খেলতাম— রোহিত, পূজা, টিকলু— ওরা সবাই কী সুন্দর নিজেদের মা’র কাছেই পড়ে। কিন্তু আমার মাম্‌মামই কেবল দেখতাম সন্ধে হলেই আমাকে আয়ার কাছে রেখে উজ্জ্বলা-আন্টি সোহিনি-আন্টিদের সঙ্গে শপিংএ কিংবা তিমির আঙ্কলের সঙ্গে মুভি দেখতে বেরিয়ে পড়ছে। বাপির কমপ্লেনের উত্তরে মাম্‌মাম ‘আমারও নিজস্ব লাইফ দরকার’ বলে ঝাঁঝিয়ে উঠত। তখন বাপিও কড়া গলায় কী সব বলত, তার মধ্যে ‘ড্রিংক’ ‘ড্রিংক’ কথাটা ঘুরে ফিরে আসত, ‘লাইফ’ও। বোধ হয় বাপি বলতে চাইত, ড্রিংক করাটাও বাপির নিজস্ব লাইফের ব্যাপার।
আমার বাপি আর মাম্‌মাম, দুজনেই নিজেদের লাইফ নিয়ে খুব কনশাস। ‘নিজেদের লাইফ’।
# #
ও, ইয়েস। যেটা বলতে যাচ্ছিলাম তখন। কথাটা ওই ‘ড্রিংক’ নিয়েই। একদম ছোট্টবেলায়, বুঝতে পারতাম না ড্রিংক নিয়ে কীসের এত অবজেকশন। মিসের কাছে শিখেছি তখন, ড্রিংক মানে পান করা। মাম্‌মাম নিজেই তো আমাকে চোখ পাকিয়ে বলে, ‘জয়, ড্রিংক সাম মোর মিল্ক, নো আরগুমেন্ট!’ বাপি কী এমন জিনিস বেশি পান করে, যাতে মাম্‌মাম রেগে যায়? বলে, ‘আই কান্ট স্ট্যান্ড’?
এখন আমি জানি। সেন্ট নিকোলাসে ভর্তি হওয়ার পর এই পাঁচ বছরে আমি অনেক কিছু জেনে গেছি। যদিও আমার বন্ধুরা বলে, ‘জয় ইউ আর স্টিল আ চাইল্ড!’ ওদের অনেকেই আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে, ওরা আমাকে সব শিখিয়ে দেয়। আমার পাশে বসে কৃপাল সিং, মাথায় কাপড়-জড়ানো ঝুঁটি— সে সেই ক-বে আমাকে বলেছিল, তার বাবা রাম খায়। শুনে তো বুঝতেই পারিনি। রাম তো সীতার হাজব্যান্ড ছিল, তাকে কী করে খাবে? হ্যাঁ, কে একটা রাক্ষুসি একবার হাঁ করে রামকে খেতে এসেছিল, কিন্তু পারেনি তো। সেই শুনে কৃপাল সিং-এর কী হাসি!
এখন আমাদের ক্লাসের সবাই জানি, কার বাবা কী খায়। কৃপালের বাবা, রনিতের বাবা, স্যামুয়েলের বাবা…
কিন্তু আমি যখন আমার বাপিকে জিগ্যেস করেছিলাম ‘তুমি রাম খাও বাবা, না স্কচ’— বাপি বলেছিল, ‘দ্যাট্‌স নান অব ইয়োর বিজনেস!’ তাই আজকাল আমি স্কুলের বন্ধুদের কাছ থেকে শেখা জিনিস বাড়িতে এসে বলি না আর।
সব জিনিস বলার মতো নয়ও।
আমাদের স্কুলবাসের লাস্ট সিটে বসে ক্লাস এইটের মনীশ ভাই। ওর চেহারাটাও বড়, হালকা গোঁফের মতো আছে— আমাদের ফাইভ-সিক্সের চার-পাঁচজনকে ওর কাছে বসিয়ে ফিসফিস করে যা সব বলে না! একদিন বলল, ‘তোরা যারা এখনও বাবা-মা’র সঙ্গে একসঙ্গে ঘুমোস, দু’একদিন ঘুমের ভান করে অনেক রাত অবধি জেগে থেকে দেখিস তো, তোদের বাবা-মা কী কী করে অন্ধকারের মধ্যে! দেখে এসে আমাকে বলবি…’
পরের দিনই স্যাম পিছনের সিটে বসে খুব এক্সাইটেড গলায় বলল, তার ড্যাডি আর মাম্মি…
রনিত দু’দিন পর জানাল, ঘর অন্ধকার ছিল বলে সে ভাল করে দেখতে পায়নি কিছু, কিন্তু ইট সিমড দ্যাট…
মনীশ ভাই মুখ টিপে হাসল, আর আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী রে, জয়? তোর বাবা-মা কিছু করে না? দেখতে পাসনি কিছু?’
আমি একটু চুপ করে থেকে, বলেছিলাম, ‘নাহ্‌। আমি তো আলাদা ঘরে শুই।’
# #
মোটেই আমি আলাদা ঘরে শুই না। মিথ্যে বলেছিলাম মনীশ ভাইকে। ইন ফ্যাক্ট, বাপি অনেকবার বলেছে আমাকে আমার নিজের ঘরে আলাদা শোয়ানোর কথা, মামমাম বলেছে আরেকটু বড় হোক, হি ফীলস স্কেয়ার্ড!
মনীশ ভাইয়ের কথামতো ঘুমের ভান করে সেই প্রথম আমি অনেক রাত অবধি জেগেছিলাম, আর দেখেছিলাম-শুনেছিলাম অনেক কিছু। কিন্তু সেগুলো ওদের সামনে বলা যায় না।
ইন ফ্যাক্ট, যে-ইনসিডেন্ট আমি দেখেছি— ইট চেঞ্জড দ্য কোর্স অব মাই লাইফ!
তখন মাঝরাত। আবছা অন্ধকারের মধ্যে ঝটাপটি হচ্ছিল। বাপি দেখলাম, কে জানে হয়তো রাগের বশেই— আই ডিডন’ট নো ক্লিয়ারলি হোয়াই— মাম্‌মামকে আনড্রেস করার চেষ্টা করছে! আর মাম্‌মাম কিছুতেই অ্যালাও করবে না! জোর একটা ঝটকা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিয়ে মাম্‌মাম উঠে বসেছিল। হাঁফাতে হাঁফাতে চাপা গলায় বলেছিল, ‘ডোন্ট বিহেভ লাইক আ ব্লাডি রেপিস্ট! বলেছি তো আমার আর্জ নেই আজ!’
আমি কাঠ হয়ে ছিলাম, আধবোজা চোখ। রাস্তার ভেপার ল্যাম্পের আলো একটুখানি এসে পড়েছিল জানলার ফাঁক দিয়ে, তাতে বাপির মুখটা কীরকম ফেরোশাস মনে হচ্ছিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল বাপি, ‘আই জাস্ট ওয়ান্টেড টু চেক্‌ দ্যাট! আজ সন্ধেবেলা… য়ু সিম্পলি গট স্পেন্ট-আপ উইথ দ্যাট বাস্টার্ড তিমির বোস, ইজনট ইট? আর তো আর্জ থাকার কথাও নয়!’
ফটাস করে চড়টা এত জোর মেরেছিল মাম্‌মাম— এত আচমকা, আমি ঘুমের ভান করতে করতেই কেঁপে উঠেছিলাম। তারপর যখন বাপি মাম্‌মামের দুটো হাত পিছন দিকে মুচড়ে দিচ্ছিল আর মাম্‌মাম কঁকাচ্ছিল খুব— আর থাকতে পারিনি। হাঁউমাউ করে কেঁদে উঠে বসেছিলাম বিছানায়।
তার পরের দিনই মাম্‌মাম দুটো বড় সুটকেস গুছিয়ে নিয়ে আমার হাত ধরে ট্যাক্সি চেপে দিদার ফ্ল্যাটে চলে গিয়েছিল। আমি তখন থেকেই দিদার বাড়ির স্টপ থেকে স্কুলবাসে উঠি।
বাপি দিদার বাড়িতে এসেছিল এক সপ্তাহ পরে। দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কথা বলেছিল দুজনে। না, মারামারি ঝগড়াঝাটির আওয়াজ পাইনি সেদিন আর। শুধু বাপি চলে যাওয়ার সময় আমাকে একটা মস্ত চকোবার দিয়ে নিচু গলায় বলেছিল, ‘আমার সঙ্গে থাকবে, জয়-সোনা, কেমন? গুড বয়!’ কী মিষ্টি করে বলল, একটুও রাগি ভাব নেই!
আর রাতে মাম্‌মাম দিদাকে বলেছিল, ‘কী করে ও কাস্টডি পায় আমিও দেখে নেব। ওর ইনকাম বেশি, তাই? হুঁহ্‌!’ সেদিন আমাকে একদম জড়িয়ে ধরে শুয়েছিল মাম্‌মাম।
যে-আমাকে ক্লাসমেটরা ‘চাইল্ড’ বলে লেগপুল করে, সেই আমি সেইদিন বুঝলাম— এই রকম করেই তবে চাইল্ডরা অ্যাডাল্ট হয়ে যায়!
# #
কালো কোট-পরা লোক দুটোও, আমাকে ‘চাইল্ড’ বলেই মেনশন করছিল বারবার।
আমি ফিল্মে দেখেছি, ওদের উকিল বলে। লইয়ার। তবে ফিল্মে যে রকম বিরাট হলঘরের মতো কোর্ট দেখায়, একদিকে সারি-সারি লোক বসে, উঁচু বেদির ওপর জজসাহেব, অনেক দূরে-দূরে মুখোমুখি দুটো উইটনেস বক্স— এই কোর্টরুমটা সেরকম নয়। ছোটমতো একটা ঘর, রোগামতো দাঁত-উঁচু একটা লোক একদিকে অল্প-উঁচু ডায়াসের ওপর গদি-আঁটা চেয়ারে বসে আছে। উকিল দুজনও একদমই ড্রামাটিক তর্কাতর্কি করল না ফিল্মের মতো, যে-যার কথা শেষ হতেই বসে পড়ল।
কিন্তু কথাগুলো ভালো নয় মোটেও। লম্বা টাকলু উকিলটা মাম্‌মামের, সে বাপিকে বলছিল ড্রাঙ্কার্ড, সিজোফ্রেনিক, সাস্‌পিশন ম্যানিয়াক। আর, প্লাম্পি ভুঁড়িওয়ালা লোকটা বাপির লইয়ার। সে মাম্‌মামকে বলল এক্সট্রাভ্যাগান্ট, সেলফ-সেন্টার্ড, ডিবচ্‌…। সব কথা আমি স্পষ্ট বুঝিনি, তবে খারাপ কথা নিশ্চয়ই, মাম্‌মামের উকিল দু’একবার প্রোটেস্ট করল, জজ একবার বললেন ওভাররুল্‌ড, একবার বললেন সাস্টেইন্‌ড।
আর বাকি যা কথা হচ্ছিল, সব আমাকে নিয়ে, আমি বুঝতে পারছিলাম। ‘চাইল্ড’, ‘কাস্টডি’, ‘অ্যালিমনি’… এইসব কথা উঠছিল বার বার। আমার দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছিল সবাই।
মাম্‌মাম আমার একটা হাত শক্ত করে নিজের মুঠিতে ধরে দিদার পাশে বসে ছিল। বাপি দেখলাম অনেকটা দূরে চুপ করে বসে আছে। আমাকে দেখে হাত নাড়ল। আমিও ভয়ে-ভয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে একটু হাসলাম, মাম্‌মাম যদিও বলে রেখেছিল আমি যেন বাপির সঙ্গে চোখাচোখি না করি— তবু আমার খুব ইচ্ছে করছিল বাপির কাছে একবার ছুটে যাই। বাপি সেই যে আমার পেটে মুখ রেখে ‘ভ্রু-উ-উ-ম’ করে একটা আওয়াজ করত সেটায় দারুণ হাসি পেত আমার— কতদিন করেনি! আর সেই-যে, কভার ড্রাইভ মারার সময় ফ্রন্টফুট-টা ঠিক কোন্‌ পোজিশনে থাকবে সেইটা সবে একটুখানি শেখাচ্ছিল আমায়, আর শেখাই হয়নি তারপর। স্কুলের ম্যাচে ড্রাইভের বল পেলে কিছুতেই মারতে পারি না, আর ঠিক পরের বলটাতেই আউট হয়ে যাই, কেন কে জানে।
বাপিকে দেখে আমার বুকের মধ্যে হালকা হালকা ফোঁপানি এল কয়েক বার।
কিন্তু মাম্‌মাম যে বলে রেখেছে, একটু লুজ্‌ পেলেই নাকি বাপি আমাকে নিয়ে চলে যাবে! সত্যি নাকি? নিয়ে চলে যাবে মানে, মাম্‌মামের কাছ থেকে— পারমানেন্টলি?
ওরে বাবা, না না, সে আমি পারব না! মাম্‌মামকে আমার চাই। আমাকে মাছের কাঁটা বেছে দেবে কে? কেডসের ফিতে সমান করে দেবে কে? স্কুল থেকে ফেরার পর ম্যাগি করে দেবে, ঘুমের সময় লালেবাই শোনাবে? বাপি আমাকে কেড়ে নিতে পারে এমন কথা ওঠার পর থেকেই, মাম্‌মাম অনেক চেঞ্জ হয়ে গেছে। খুব কেয়ার নেয় আমার।
‘আই লাভ মাই মাম্‌মাম।’
উইটনেস বক্সে ডেকে জজসাহেব যখন খুব মিষ্টি করে জানতে চাইলেন আমি কাকে বেশি পছন্দ করি, কাকে রিলাই করি বেশি, কার কাছে থাকলে আমার বেশি ভালো লাগবে— আমি মাম্‌মামের দিকে তাকিয়ে ওই সেন্টেন্সটাই প্রথম বলেছিলাম।
তারপর, মাম্‌মামের ঝলমলিয়ে-ওঠা মুখ থেকে আমার চোখটাকে আস্তে আস্তে ঘুরিয়ে বাপির দিকে তাকিয়ে দেখি, কালো হয়ে গেছে বাপির মুখ, মাথাটা নামিয়ে নিয়ে চুপ করে বসে আছে।
‘অ্যান্ড আই ইকুয়ালি লাভ মাই বাপি, টু!’
চমকে উঠে বাপি তাকিয়েছিল আমার দিকে। চোখ মুছেছিল।
আমি, ক্লাস ফাইভের জয়, সোজা জজসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, ‘প্লিজ আস্ক দেম টু লিভ টুগেদার উইথ মি। অ্যান্ড নট টু ফাইট এনি মোর। প্লিজ।’
# #
দু’দিন হল আমরা এই সী-সাইডে বেড়াতে এসেছি। এর আগে একবার এসেছিলাম, মনে আছে, তখন মর্নিংএ পড়ি, টুয়ে বোধহয়। সমুদ্রে নেমে খুব হুড়োহুড়ি, সন্ধেবেলায় সী-বিচের ধারে কত মজা! সেই ট্যুরে ঝগড়া হয়নি একটুও।
এই ট্যুরেও ঝগড়া করতে বারণ করেছেন জজসাহেব। পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘গিভ এফর্টস। একবার শেষ চেষ্টা করে দেখুন দুজনেই। বেড়িয়ে আসুন একসঙ্গে, ফরগেট দ্য পাস্ট। ফর দ্য সেক অব দ্য কিড…’
কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই, কাল রাতে আবার ওরা শুরু করে দিয়েছে। সেই এক ইস্যু। বাপি হোটেলের ঘরে ড্রিংক করতে চায়, মাম্‌মামের তাতে স্ট্রং অবজেকশন। মাম্‌মাম নাকি গন্ধটাই স্ট্যান্ড করতে পারে না।
বাপি প্রথমটায় নরম গলায় রিকোয়েস্ট করছিল ; টানা আটচল্লিশ ঘণ্টা উইদাউট অ্যালকোহল… ফীলিং ডেসপারেটলি থার্স্টি… জয় তো ঘুমিয়ে পড়েছে, এখন জাস্ট দু-তিনটে পেগ…
আমি যে ঘুমোইনি অ্যাট অল— ওরা কেউ ভাবতে পারেনি বোধহয়। দু’চারটে হট এক্সচেঞ্জের পরেই ভায়োলেন্ট হয়ে উঠল দুজনেই।
‘নো! আই হেট শেয়ারিং বেড উইথ আ ড্রাঙ্কার্ড!’ —ডিসকভারি চ্যানেলে কিং কোবরা যেমন হিসহিস করে, একদম সেই রকম ভঙ্গিতে কথাগুলো বলেছিল মাম্‌মাম।
‘ও, ইজ ইট?’ বাপির নরম গলাটাও সেকেন্ডের মধ্যে যেন নেকড়ের গর্জন, ‘অ্যান্ড আই অলসো হেট টু স্লিপ উইথ আ হোর!’
‘হোয়াট?’
‘আজও তুমি ওই সান-অব-আ-বিচ্‌ তিমির বোসকে ফোন করেছিলে না, গয়না কেনার ছুতোয় সী-বিচ থেকে সরে গিয়ে? সব আমার ভিজিলে আছে!’
‘বেশ করেছি! হেল উইথ ইয়োর সাস্‌পিশন অ্যান্ড হেল উইথ ইয়োর ভিজিল! আমার যখন খুশি যাকে খুশি ফোন করব, নেভার ট্রাই টু পোক ইয়োর আগলি নোজ্‌, ওকে? তোমার খবর আমি রাখি না? এবার ট্যুরে গিয়ে সেক্রেটারির সঙ্গে…’
তারপর আরও, আরও। সারারাত। সেই হুবহু আগের মতো সব! পুরো ডাস্টবিন উপুড় করছিল দুজন মিলে।
আর, আমি শুয়েছিলাম চুপচাপ। আমার বোজা চোখের কোণ দিয়ে গরম জল গড়াচ্ছিল।
# #
আমি আজ ওদের লুকিয়ে একা একা সী-বিচ ধরে চলে এসেছি বহুদূর। খুব চুপিসাড়ে আস্তে আস্তে সরে এসেছি, দুজনেরই নজর এড়িয়ে। এইরকম অচেনা জায়গায় হারিয়ে যাওয়া খুব সহজ। বিচের যেদিকটা একেবারে ফাঁকা— সেইদিকে হাঁটা লাগালেই, ব্যস! সেপারেটেড! এবার কোন্‌দিকে খুঁজবে খোঁজো!
হাঁটতে হাঁটতে, হাঁটতে হাঁটতে… কত্ত দূর এসে গেলাম! কতক্ষণ হাঁটছি? এক ঘণ্টা, না আরও বেশি? এতক্ষণে ওরা দুজনেই টেনশন করছে খুব, ফর শিওর! খুঁজছে আমাকে পাগলের মতো? ছোটাছুটি করছে? সী-বিচে খুঁজছে, মার্কেটে খুঁজছে, রাস্তায়? কাঁদছে কি? খুব?
মাম্‌মাম তো ডেফিনিটলি কাঁদছে। আর বাপি? বাপি সহজে কাঁদে না, কিন্তু সেই কোর্টরুমে দেখেছিলাম…
আচ্ছা, এখানে থানা আছে নিশ্চয়ই। ওরা কি থানায় যাবে? বোধহয় চলেই গেছে এতক্ষণে! আমি বেশ ইমাজিন করতে পারছি, থানায় বসে মাম্‌মাম কাঁদতে কাঁদতে ফেইন্ট হয়ে যাচ্ছে… আর বাপি মাম্‌মামকে ধরে বসে আছে শক্ত করে। ক্লোজ অ্যান্ড টাইট! নো মোর ফাইট! …সীন’টা ভাবতেই ভালো লাগে খুব।
ইয়াপ্‌, এখন তো আমি বুঝে গেছি কেসটা! যার কাছ থেকেই আমাকে কেড়ে নেওয়ার মতো সিচুয়েশন তৈরি হয়, সে-ই তখনকার মতো বদলে যায়। হি, অর শি, পাইনস ফর মি। বিহেভস লাইক আ রিফর্মড সোল। বাট, সেপারেটলি!
এখন অবিশ্যি, একসঙ্গে! এই প্রথম! হি হি। নাও, বোঝো দুজনেই! ভেবে ভেবে কেমন একটা সলিউশন বের করেছি আমি, দ্যাখো জাস্ট!
কিন্তু, আমি এ কোথায় চলে এলাম কে জানে! একদম ফাঁকা চারদিক। একদিকে ধু-ধু বালি, অন্যদিকে ঢেউ আর ঢেউ! আর আকাশ… ভাস্ট অ্যান্ড সাইলেন্ট! ডেসোলেট অ্যান্ড লোনলি! কেউ কোথাও নেই। কেউ আসে না এদিকে? কেন কে জানে!
আচ্ছা, আচ্ছা, দাঁড়াও! সেদিন স্নান করতে নেমেছিলাম যখন, কয়েকটা লোকের সঙ্গে বাপি গল্প করছিল। তারা বলছিল, এখানকার বিচে অনেক দূরে কোথায় না কি চোরাবালি আছে! কুইক স্যান্ড! সে দিকটায় কেউ যায় না। চোরাবালি মানে, যেখানে পা রাখলেই মানুষ না কি ডুবে যায়…
আমি কি সেই চোরাবালির দিকটাতেই চলে এসেছি না কি? সেই জন্যেই এত ফাঁকা এদিকটা?
চোরাবালি! কেমন হয় সেটা?
আমি জানি না ঠিক। শুনেছি, বাইরে থেকে না কি কিচ্ছু বোঝা যায় না! ওপরে সব ন্যাচারাল, কিন্তু ভেতরে ফাঁপা… এই রকম? এমন যদি হয় যে, আর কয়েক পা এগোলেই চোরাবালি শুরু? হয়তো এখনই সেই ডেঞ্জারলাইনের ওপরেই আমার পা’টা রাখা আছে!
বিরাট বিচের মধ্যে আমি একা। বিশাল সমুদ্রের সামনে, মস্ত আকাশের নিচে… একা। আমার একটু-একটু ভয় করছে। কান্না পাচ্ছে একটু একটু।
নাহ্‌। কাঁদব না। আমি চোয়াল শক্ত করছি।
লেট দেম পাইন ফর এভার। লেট দেম রিপেন্ট। বোথ অব দেম।
আমি বরং আরও এগিয়ে যাই।।

No comments