জাতিসংঘ, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু
#ড.এ কে আব্দুল মোমেন
স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম; একটি চেতনা ও অধ্যায়। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শী কূটনীতির ফলে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর খুব স্বল্পকালের মধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে বৈশ্বিক স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়। বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অবস্থান শক্ত করতে প্রথম থেকেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দেন এবং সে ভাষণে তিনি প্রায় ২৫টি ইস্যু তুলে ধরেন, যা এখনও মানব জাতিকে নাড়া দেয়। সেই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন, যা এখনও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন- 'বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার উপর ভিত্তি করিয়া জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে।' আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বিরূপ বা শত্রুতা নেই। তার এ কালজয়ী নীতির ফলে বিশ্বসভায় বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত সম্মানের ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
'সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারও প্রতি বৈরিতা নয়'- বঙ্গবন্ধু ঘোষিত এই পররাষ্ট্রনীতির কারণে জাতিসংঘে বাংলাদেশের দৃশ্যত কোনো শত্রু দেশ না থাকায় বর্তমান সরকারের প্রথম ছয় বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রায় ৫২টি কমিটি, কমিশন, ব্যুরো বা নেতৃত্বের আসনে নির্বাচিত হয়। বস্তুত কোনো নির্বাচনেই বাংলাদেশকে পরাজিত হতে হয়নি। এর মূল কারণ বঙ্গবন্ধুর নীতি আমাদের কোনো চিহ্নিত 'শত্রু দেশ' নেই। দ্বিতীয়ত, এ দেশের নীতি ও উদ্যোগ ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর এবং তৃতীয়ত, এ দেশের প্রতিনিধিরা যেসব কমিটি, কমিশন ইত্যাদিতে নির্বাচিত হয়েছেন, সেসব সংস্থায় সবাইকে সঙ্গে নিয়ে, কার্যকরী বাস্তব পদক্ষেপ নিয়ে সবার আস্থা ও সম্মান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এত নির্বাচনে জয়লাভ বস্তুত শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি বিশ্ববাসীর আস্থা ও বিশ্বাসের ফলশ্রুতি। বঙ্গবন্ধু সম্মিলিত জাতিসংঘে 'শান্তি ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা'র জোরালো অঙ্গীকার করেন। সুখের বিষয়, তার সে অঙ্গীকার আজ প্রতিপালিত হচ্ছে সুনিপুণভাবে। বাংলাদেশ আজ জাতিসংঘের শান্তি মিশনে এক নম্বরে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের প্রায় এক লাখ ৫৪ হাজার শান্তিরক্ষী নিয়োজিত হন এবং দেশ ও দশের জন্য তারা সুনাম বয়ে আনেন। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে পাক-ভারত উপমহাদেশে 'শান্তির দূত' হিসেবে সমধিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশের শান্তির কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে।'
বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও সমঝোতা রক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে যে ভাষণ তিনি দিয়ে গেছেন, তা-ই প্রতিফলিত হচ্ছে আজ বাংলাদেশের অবস্থানে। তার সুকন্যা, এ দেশের সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার কারণে উপমহাদেশে বাংলাদেশ আপস, ন্যায়নীতি, পরিপকস্ফতা ও সমঝোতার পররাষ্ট্রনীতি প্রচলন করেছে। বাংলাদেশ ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের সমঝোতায় কোনো প্রকার যুদ্ধ বা ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই আইনের মাধ্যমে সমুদ্রসীমার সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে। ৬৫ বছরের অমীমাংসিত বেরুবাড়ীসহ সীমান্ত ছিটমহলগুলোর হস্তান্তর শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের মধ্যে ট্রানজিট ও যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উদ্ঘাটিত হচ্ছে। আজ বাংলাদেশ 'ভারত ও নেপাল' এবং 'ভারত ও ভুটান'-এর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্ব গভীর ও অর্থবহ করার ক্ষেত্রে মডারেটরের ভূমিকা পালন করছে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও ভবিতব্য আজ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ সনদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান এবং অদ্যাবধি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এর কোনো ব্যত্যয় হয়নি। তিনি ১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জাতিসংঘে এর সপক্ষে জয়গান গেয়েছেন। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ বা 'ন্যাম' সংস্থার অন্যতম নেতা। ২০১৬ সালে ন্যাম সম্মেলনের চেয়ারম্যান হওয়ার সুযোগ বাংলাদেশ পেয়েও কোনো অজ্ঞাত কারণে তা বিসর্জন দেয়। ১৩২ দেশের সমন্বয়ে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর চেয়ারম্যানের দায়িত্বভার এশিয়া প্যাসিফিক রাষ্ট্রগুলোর ভাগে আসে এবং বাংলাদেশ এর দায়িত্বভার নেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। বস্তুত যখন বাংলাদেশের প্রার্থিতা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, তখন হঠাৎ আমাদের পররাষ্ট্র দপ্তর বাংলাদেশের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করলে থাইল্যান্ডের সামরিক সরকারের ভাগ্য খুলে যায়। তারা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০১ সালে ঢাকায় ন্যাম সম্মেলন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় এবং কনভেনশন সেন্টারও তৈরি হয়। তবে বিএনপি সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা দখল করেই তা বাদ দেয়।
বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে সংগ্রাম করার দৃঢ়প্রত্যয়ই শুধু ঘোষণা করেননি; এর সঙ্গে সব দেশকে একত্রিত হয়ে তা দূর করতে আহ্বান জানান। সুখের বিষয় এই, আজ বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা দেশনেত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ পরিচালনায় দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে এবং ২০১৫ সালে জাতিসংঘের সব রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সম্মতিতে ২০৩০ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা বিশ্ব থেকে চিরতরে নির্মূল করার জন্য যে ১৭টি টেকসই লক্ষ্যমাত্রা এবং ১৬৯টি টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে, বাংলাদেশ তাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এই 'টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ও টার্গেট অর্জন' করতে দেশজুড়ে সবাইকে নিয়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে শেখ হাসিনা সরকার। এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন 'সোনার বাংলা' অর্জনের পথে। বঙ্গবন্ধু তাঁর জাতিসংঘের ভাষণে নিপীড়িত মানব জাতির সপক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন এবং বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত দক্ষিণ আফ্রিকা ও ফিলিস্তিনি নিপীড়িত জনগণের বৈধ অধিকারের প্রতি জোর সমর্থন জানান। আজও বাংলাদেশ তার নীতিতে অবিচল ও সোচ্চার। বঙ্গবন্ধু আণবিক বোমার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন এবং ভারত মহাসাগর ও উপমহাদেশকে 'শান্তি এলাকা' হিসেবে ঘোষণার স্বপ্ন দেখেন। তিনি গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র রোধ করার পক্ষে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন জাতিসংঘসহ বিভিন্ন অধিবেশনে। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সব সংস্থায় আণবিক বোমা বন্ধ ও নিশ্চিহ্নকরণ এবং অধিকতর মারণাস্ত্র তৈরি বাবদ খরচ বন্ধ করে তা ক্ষুধা-দারিদ্র্য-অশিক্ষা-রোগ নিরাময় এবং উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যয় করার জোরালো দাবি জানিয়ে আসছে।
জাতিসংঘের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যা এবং সহযোগিতার ওপর জোর দেন। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ তা অর্জনের জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহ অবস্থা জাতিসংঘে তুলে ধরেন এবং ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আনন্দের কথা হলো, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলা করায় ১ নম্বর মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো দূর করার জন্য সব রাষ্ট্র, বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের মতো বড় বড় বাধা কারও পক্ষে এককভাবে পেরিয়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। অংশীদারিত্বমূলক উন্নয়ন সবচেয়ে টেকসই হয়। বর্তমানে জাতিসংঘও পার্টনারশিপের ওপর জোর দিচ্ছে। পার্টনারশিপের সংখ্যা আরও বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে সব স্টেকহোল্ডার; রাষ্ট্র, সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও, সিভিল সোসাইটি ইত্যাদি নেতৃত্বের সমন্বয়ে ও যৌথ উদ্যোগের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘে খাদ্য উৎপাদন ও স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের ওপর জোর দাবি তোলেন বঙ্গবন্ধু এবং বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্টম্ফীতি কমানোর তাগিদ দেন। তিনি সব জাতির ঐক্যের প্রতি জোর দেন এবং সব জাতির পারস্পরিক স্বনির্ভরতার স্বীকৃতি প্রদানে জোরালো ভূমিকা রাখেন। সম্মিলিত জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সব ভাষা-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা, তাদের উন্নয়ন ও শ্রীবৃদ্ধিতে অঙ্গীকারবদ্ধ।
জাতিসংঘে 'বাংলা ভাষায়' ভাষণ প্রদান করে দেশের ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বসভায় সম্মানিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। পরে তাঁরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা পরপর ছয়বার জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে সবাইকে চমকিত করেন। বঙ্গবন্ধু একবার মাত্র জাতিসংঘে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর সেই ভাষণে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির যে নকশা ও দিকনির্দেশনা দিয়ে গেলেন, তা আজও আমাদের আলোর দিশারি। মানব জাতির কঠিন সমস্যাগুলো, যা তিনি তাঁর ভাষণে তুলে ধরেন সেগুলো আজও বিশ্ববাসীর জীবনকে করে তুলেছে সংকটময় ও বিপদসংকুল। বিশ্ব এখনও লড়াই করছে সেসব সংকট মোকাবেলায়। তার সুদূরপ্রসারী চিন্তাধারা ও বৈশ্বিক শান্তির অনুধাবন আজও বিশ্বব্যাপী আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। সেই ধারাবাহিকতায় গত মাসে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সদর দপ্তরে যথাযোগ্য মর্যাদা ও অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস পালন করা হয়। সে অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে 'ফ্রেন্ড অব দ্য ওয়ার্ল্ড' বা 'বিশ্ববন্ধু' হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে এ উপাধি প্রদান করে জাতিসংঘ নিজেদের ভাবমূর্তিই উজ্জ্বল করেছে। বাঙালির প্রাণপুরুষ আজ বিশ্বপ্রেরণার বাতিঘর।
মন্ত্রী, পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রণালয়
সমকাল
No comments