কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধা ও অসুবিধা সমূহ
বিদ্যুৎ আধুনিক বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে অসীম সম্ভাবনাময় যুগের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্যুৎ ছাড়া সভ্যতার সমস্ত গতি ও আধুনিক প্রযুক্তি এক কথায় অচল। বিদ্যুৎ আধুনিক প্রযুক্তি, কৃষি, চিকিৎসা, শিল্পোৎপাদন সবকিছুর চালিকা শক্তি। এ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় জ্বালানি পুড়িয়ে, জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে, বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে অথবা সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে। জ্বালানির ক্ষেত্রে আবার পারমাণবিক জ্বালানি এবং রাসায়নিক জ্বালানি এ দুটি ভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে প্রাকৃতিক গ্যাস বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের সংখ্যাই বেশি।
কয়লাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা আছে, এর পাশাপাশি অনেক বড় বড় অসুবিধাও আছে। এ বিষয়ে তাহলে আলোচনা করা যাক।
কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুবিধাঃ
তাপশক্তিঃ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন প্রচুর তাপশক্তি। কয়লার সরাসরি দহনের ফলে তাপশক্তি উৎপাদন হয়। কয়লার মধ্যে এ শক্তি রাসায়নিক শক্তি হিসেবে থাকে। দহনের ফলে এ রাসায়নিক শক্তি তাপশক্তিতে পরিবর্তিত হয়। কয়লার দহনের ফলে উৎপন্ন তাপশক্তির পরিমাণ খুবই বেশি। এ তাপশক্তিকে কাজে লাগিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়ে থাকে।
সহজলভ্যতাঃ কয়লা খুবই সহজলভ্য উপাদান। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই খনিতে একে পাওয়া যায়। আমাদের দেশে বেশ কয়েকটি কয়লার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বড় পুকুরিয়া কয়লার খনি থেকে প্রতিদিন ৬৫০ টন কয়লা উত্তোলন করা হয়ে থাকে। কাঁচামালের সহজলভ্যতার কারণে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সুবিধাজনক।
সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় রেন্টাল, কুইক রেন্টালের পাশাপাশি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিশেষ মনোযোগ থাকলেও এখন দীর্ঘমেয়াদে কয়লাভিত্তিক নতুন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের দিকে ঝুকেছে। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাগেরহাটের রামপালে ভারতের সাথে যৌথ বিনিয়োগে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মালয়েশিয়া ও চীনের অর্থায়নে কক্সবাজারের মহেশখালীতে প্রতিটি ১০০০ মেগাওয়াট করে আরও দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি আইপিপির মাধ্যমে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল আরও পাঁচটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলমান।
উপাদানের মূল্যঃ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল জ্বালানি হলো কয়লা। এর মূল্য যথেষ্ট কম। তদুপরি কয়লা দেশের খনিতেই পাওয়া যাবে। একে আমদানি করার প্রয়োজন পড়বে না। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ঘটবে না। যেখানে তেল আমদানি করতে হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়।
বড় ধরণের প্রকল্প গ্রহণঃ যেহেতু কাঁচামাল দেশিয়, তাই বড় ধরণের প্রকল্পকে হাতে নিতে পারে সরকার। শুধুমাত্র প্রকল্প প্রতিষ্ঠার ব্যয় নির্বাহ করতে পারলে অতি সহজেই এ ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
নিজস্ব পরিকল্পনাঃ নিজস্ব পরিকল্পনা মাফিক চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী এ ধরণের প্রকল্প গ্রহণ করা সম্ভব হয়। দেশের ভৌগলিক অবকাঠামো ও স্থান বিশেষের চাহিদা অনুযায়ী পরিকল্পনা করা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
বিকল্প জ্বালানির উৎসঃ দেশে এখনও বিদ্যুৎ ঘাটতি। অব্যাহত বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবেলায় সরকার রেন্টাল, কুইক রেন্টালের পাশাপাশি গাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। গ্যাসের একক ব্যবহার ও তেলের উপর নির্ভরতা কমাতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উপর এতটা গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সরকারের আছে। এর ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ২০১৩ সালে মাত্র ২২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ০৫/১০/২০১৩ সালে খুলনার রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ সরকারি উদ্যোগে শুরু করা হয়েছে।
কর্মসংস্থানঃ এ ধরণের প্রকল্পের মাধ্যমে অনেক লোকের কর্মসংস্থান ঘটে। কয়লার উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহণ, প্রকল্পে ব্যবহার সবক্ষেত্রেই বিরাট জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা।
এছাড়াও জাতীয় প্রকল্পের প্রযুক্তিবিজ্ঞান খুবই সাধারণ। প্রকল্পে ছোট আকার হতে বড় আকারে সম্প্রসারণ করা যায়।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অসুবিধাঃ
পরিবেশঃ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থাকে। কয়লার উত্তোলনের ফলে ভূমির ক্ষতি হয়। কয়লাক্ষেত্র বিরাট অঞ্চল জুড়ে থাকে। এসব অঞ্চলে জনবসতিসহ অন্যান্য স্থাপনাও থাকতে পারে। তাছাড়া কয়লা মানেই ময়লা। তাই কয়লা পরিবেশকে কুলষিত করে থাকে।
উৎপন্ন ছাইঃ কয়লার দহনের ফলে অবশেষ হিসেবে যথেষ্ট পরিমাণে ছাই উৎপন্ন হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৩০-৩৫ ভাগ। এ বিশাল পরিমাণের ছাই সংরক্ষণ করা খুবই দুরুহ বিষয়। জলাভূমি বা নদী বা সাগরে ফেলে দিলেও পরিবেশের ক্ষতি সাধন করে থাকে।
বর্জ্য গ্যাসঃ কয়লাকে দহনের সময় তা থেকে বিভিন্ন ধরণের বায়ুদূষক বর্জ্য গ্যাসীয় পদার্থের সৃষ্টি হয়। কয়লার মধ্যে S, N, P, As প্রভৃতি উপাদান মৌল বর্তমান থাকে। কয়লার দহনের সময় এরা অক্সাইড যৌগে পরিণত হয়। যেমনঃ S থেকে SO2 গ্যাস, এটি খুবই ক্ষতিকারক গ্যাস। WHO এর পরিসংখ্যানে দেখা যায় সমগ্র পৃথিবীতে শিল্প কারখানা থেকে বছরে প্রায় বিশ কোটি টন বিষাক্ত SO2 গ্যাস বাতাসে মিশছে।এসব SO2 বাতাসের জলীয় বাষ্পের সাথে মিশে H2SO4 উৎপন্ন করে থাকে। যা কিনা এসিড বৃষ্টির কারণ। উৎপন্ন SO2 এর শতকরা ৩৫ ভাগই আসে কয়লার দহনের ফলে। এছাড়া N হতে NO2, P হতে P2O5, As হতে As2O3 উৎপন্ন হয়ে থাকে। যার সবকটিই মারাত্মক ক্ষতিকারক।
স্থানান্তরঃ প্রকল্পটি যে স্থানে প্রতিষ্ঠিত করা হয় সেখান হতে অন্যত্র আর স্থানান্তর করা সহজ হয় না।
ভূমির ব্যবহারঃ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে যথেষ্ট ভূমির ব্যবহার ঘটে থাকে। খনি থেকে কয়লার উত্তোলন, সংরক্ষণ, পরিবহন ও পুনরায় সংরক্ষণ সবক্ষেত্রেই যথেষ্ট ভূমির প্রয়োজন হয়।
যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ এক্ষেত্রে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন পড়ে। কয়লার পরিবহনের জন্য উন্নত অথচ কম ব্যয়বহুল পরিবহন ব্যবস্থা থাকার প্রয়োজন।
বাংলাদেশের কয়লা ক্ষেত্র সমুহঃ
বড় পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্র
জামালগঞ্জ কয়লা ক্ষেত্র
খালাসপীর কয়লা ক্ষেত্র
দিঘীপাড়া কয়লা ক্ষেত্র
ফুলবাড়ি কয়লা ক্ষেত্র
পত্নীতলা কয়লা ক্ষেত্র
অন্যান্য ক্ষেত্রঃ উল্লেখিত কয়লা ক্ষেত্র ছাড়াও বগুড়া জেলার নন্দিগ্রামে, সিলেট জেলার লালঘাট, লামাকাটা, ভাঙ্গার ঘাট ও টেকের হাট এবং রংপুর জেলার বীরগঞ্জেও উন্নত মানের কয়লার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে।
এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন যায়গায় পীট কয়লা পাওয়া যায় যা বেশ উল্লেখযোগ্য।
লেখাটি আপনার কতটা উপকারে আসলো তা কমেন্ট করে জানান এবং আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করুন। নিজে জানুন অন্যকে জানতে সাহায্য করুন।