বাংলা সাহিত্যে কবিতা পত্রিকার গুরুত্ব
১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা অক্টোবর (১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে) কলকাতায় বসবাসকালে বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্রের সহযোগিতায়, অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের যুগ্ম-সম্পাদনায় কবিতা ও কবিতা বিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা "কবিতা" প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ছিলেন সমর সেন। পত্রিকাটির প্রথম দু'বছরের সম্পাদক ছিলেন বুদ্ধদেব বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্র। যৌথ সম্পাদনায় পত্রিকাটি প্রকাশিত হলেও বুদ্ধদেব বসুই এর প্রধান পরিচালক ছিলেন।
♠¤ পরিচিতি :-
পঁচিশ বছরেরও অধিককাল বুদ্ধদেব বসু "কবিতা" পত্রিকাটির ১০৪টি সংখ্যা সম্পাদনা করে আধুনিক কাব্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তৃতীয় বর্ষ ১ম সংখ্যা (আশ্বিন, ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) থেকে বুদ্ধদেব ও সমর সেন এবং ষষ্ঠ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা (চৈত্র, ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ) থেকে বুদ্ধদেব বসু একাই এর সম্পাদক ছিলেন। তাঁরই অনুপ্রেরণায়, সদিচ্ছায়, অনুশাসনে এবং নিয়ন্ত্রণে আধুনিক বাংলা কবিতা তার যথার্থ আধুনিক রূপ লাভ করে। এটি কবি বুদ্ধদেব বসুর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য কীর্তি। "কবিতা" পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যার মূল্য ছয় আনা, বার্ষিক মূল্য দেড় টাকা।
♥¤ প্রধান বিষয় :-
১৯৩০-এর দশকে একদল তরুণ কবি বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রপ্রভাব উপেক্ষা করে পাশ্চাত্যের আধুনিক কবিতার রীতি অনুসরণ করে কবিতা রচনায় মেতে উঠেছিলেন। এ আধুনিক কবিদের মুখপাত্র ছিল "কবিতা" পত্রিকা। অনেক নিরীক্ষণধর্মী কাব্যচর্চা করা হয়েছে এতে। বাংলা ভাষায় গদ্য-কবিতার সূচনা ও বিকাশ এই পত্রিকার হাত ধরে। সে সময় এই পত্রিকাটির সঙ্গে জড়িত ছিল তরুণ কবিদের আড্ডা "কবিতা ভবন" এবং "কবিতা ভবন প্রকাশনা"।
♥¤ সাহিত্যে অবদান :-
"কল্লোল", "কালিকলম" পত্রিকার মতোই "কবিতা" পত্রিকাও নতুন পথ এবং নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখিয়েছে। এই গোষ্ঠীর লেখকদের মূল কথাই ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রদর্শিত রোমান্টিক ভাবাবেগে জড়িয়ে থাকলে চলবে না, সাহিত্যের আঙিনায় পত্তন করতে হবে নতুন কালের। বুদ্ধদেব বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কবিরা এই পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। "কবিতা" পত্রিকার প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার প্রথম কবি ছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। তাঁর সেই প্রথম কবিতাটির নাম হল "তামাসা"। দ্বিতীয় বর্ষ থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র পত্রিকা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তাঁর জায়গায় সম্পাদক হিসাবে আসেন সমর সেন। কিন্তু এক বছর পরেই সম্পাদনা ও প্রকাশনার দায়িত্ব এককভাবে চলে আসে বুদ্ধদেব বসুর হাতে। এই পত্রিকাটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের "সাহিত্যের স্বরূপ" (১৯৪৩), জীবনানন্দ দাশের "কবিতার কথা" (১৯৫৫), আবু সয়ীদ আইয়ুবের "কাব্যের বিপ্লব ও বিপ্লবের কাব্য", বুদ্ধদেব বসুর "কবি ও তার সমাজ" প্রভৃতি প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৩৪২ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাস থেকে ১৩৬৭ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাস পর্যন্ত "কবিতা" পত্রিকার পঁচিশ বছরের জীবনকালে সর্বমোট ৩৪৫ জন লেখক এই পত্রিকাটিতে অবদান রেখে গেছেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, সমর সেন, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অজিত কুমার দত্ত, প্রতিভা বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, পরিমল রায়, নরেশ গুহ, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, অমিয় চক্রবর্তী, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, শামসুর রাহমান, আবু সয়ীদ আইয়ুব, হুমায়ুন কবির, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আনোয়ার পাশা, আল মাহমুদ, মোফাজ্জাল হায়দার চৌধুরী, আলাউদ্দীন আল আজাদ, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ কবিরা।
♣¤ উল্লেখযোগ্য তথ্য :-
"কবিতা" পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীর্ঘ পত্রে পত্রিকার সম্পাদক কবি বুদ্ধদেব বসুকে তাঁর সুখকর মতামত জানিয়েছিলেন।
♣¤ বৈশিষ্ট্য :-
"কবিতা" পত্রিকার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল কবিতা, কবিতা-সমালোচনা, কবিতাবিষয়ক প্রবন্ধ। এই পত্রিকার অপর একটি বৈশিষ্ট্য বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করা, যেমন "রবীন্দ্র সংখ্যা", "নজরুল সংখ্যা", "জীবনানন্দ সংখ্যা" ইত্যাদি। কাব্যের রূপ ও রীতি বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যা বেরিয়েছিল তৃতীয় বর্ষ, বৈশাখ ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে। এটি ছিল "সমালোচনা সংখ্যা"।
♦¤ গুরুত্ব :-
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমবিকাশে ''কবিতা" পত্রিকার ভূমিকা (গুরুত্ব) দূরসঞ্চারী। আধুনিক বাংলা কবিতার সমৃদ্ধি, প্রসার ও তা জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে "কবিতা" পত্রিকা তুলনারহিত। "কবিতা" বাংলা সাহিত্যের একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যুগ সৃষ্টিকারী পত্রিকা। পঁচিশ বছরের (১৯৩৫-১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ/১৩৪২-১৩৬৭ বঙ্গাব্দ) "কবিতা" পত্রিকার যুগকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবিতার পরিপূর্ণতার যুগ বলা যেতে পারে। এই সময় আধুনিক কবিতার সব ধরনের প্রয়োগ এই পত্রিকাটিতে স্থান পেয়েছে।
No comments