নাট্যকথনঃ মাইকেল মধুসূদন দত্ত
আজকের নাটকঃ পদ্মাবতী।
রচনা ও প্রকাশঃ প্রচলিত তথ্যমতে ১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটি রচনা করেন এবং ঐ বছরেই এটি প্রকাশিত হয়। তবে কবির জীবনপাঠে জানা যায় এটি ১৮৫৯ সালে রচিত হয় এবং ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়।
বিশেষত্বঃ
১. এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক কমেডি
২. এই নাটকের পদ্যাংশের মাধ্যমেই কবি সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করেন।
বিষয়বস্তুঃ
এই নাটকে নাট্যকার গ্রীক পৌরাণিক গল্পকে দেশীয় দেব দেবীদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেশী আবহাওয়ায় সাজিয়েছেন। এটিকে গ্রীক পুরাণের অ্যাপল অব ডিসকর্ডের দেশীয় সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই এটিকে মৌলিক সৃষ্টিকর্ম হিসেবে মেনে নিতে চাননা।
মূলগল্পঃ
গ্রিক পুরাণের গল্পটির সূচনায় দেখানো হয় স্বর্গে উপদেবী থেটিস সমুদ্র দেবতা পোসাইডন কে পরিত্যাগ করে বিয়ে করছিলেন মানব পেলিয়াসকে। এরাই গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের পিতামাতা। এই বিবাহ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সকল দেবদেবী। কিন্তু বাদ পরে যান বিবাদের দেবী এরিস। ক্রুদ্ধ দেবী এরিস এবার হেসপেরাডাইসের বাগান থেকে একটি সোনার আপেল এনে সোনালি কাপড়ে মুড়ে তা ছুড়ে দেন ভোজ সভায়। সেই মোড়কে লিখা ছিল সর্বাপেক্ষা সুন্দরী দেবী এই আপেলের মালিক হবেন। দাবি নিয়ে এগিয়ে এসে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিন দেবী- বিবাহের দেবী ও দেবরাজ জিউসের স্ত্রী হেরা, জ্ঞানের দেবী এথেনা ও সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি। দেবকুলের কেউ তাদের বিবাদের মিমাংসা করতে ব্যর্থ হলে জিউসের পরামর্শে এই তিনজন দেবী পৃথিবীতে যান ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের পুত্র প্যারিসের কাছে।
হেরা প্যারিসকে রাজত্বের, এথেনা যুদ্ধজ্ঞানের এবং আফ্রোদিতি প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী হিসেবে নির্বাচিত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু প্যারিসের কাছে রাজত্ব, যুদ্ধজ্ঞানের চেয়ে সৌন্দর্যের আকর্ষণ বেশি হওয়ায় সে আফ্রোদিতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী এবং স্বর্ণ আপেলের দাবিদার বলে ঘোষণা করেন।
তার এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আফ্রোদিতি তাকে বর প্রদান করেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী লাভ করবেন প্যারিস। কিন্তু ক্ষিপ্ত দেবমাতা হেরা এবং জ্ঞানদেবী এথেনা তার জীবন নারকীয় কষ্টে পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
দেবীদের প্রত্যেকেই তাদের প্রতুশ্রুতি রক্ষা করেন। দেবী আফ্রোদিতির প্রভাবে প্যারিসের ভালোবাসায় মজেন যুদ্ধবাজ হিসেবে খ্যাত স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেন। কিন্তু হেরার কারণে সেই প্রণয় পরিণয়ে রূপান্তরের পথে আসে হাজারো বাঁধা। এথেনার প্রভাবে মেনেলাউসের ভাই আগামেননের নেতৃত্বে ও প্ররোচনায় সকল গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী ট্রয় আক্রমণ করেন এবং এপোলোর অভিশাপের বাস্তবায়নে প্যারিসের কারণেই তার পিতৃরাজ্য ধংশ হয়। যদিও আফ্রোদিতির চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মিলন হয় প্যারিস ও হেলেনের।
পদ্মাবতীর চরিত্র চিত্রণঃ
পদ্মাবতীতে নাট্যকার গ্রিক চরিত্র সমূহকে দেশীয় দেবদেবীদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ দেশীয় আবহে। প্রথমেই চরিত্র সমূহের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
১. ইন্দ্রনীলঃ বিদর্ভনগরের রাজা। প্যারিসের স্থলে তাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
২. পদ্মাবতীঃ মাহেশ্বরীপুরির রাজকন্যা এবং নাটকের নাম চরিত্র।
৩. শচী দেবীঃ দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী।
৪. মুরজা দেবীঃ ধনপতি কুবেরের স্ত্রী
৫. রতি দেবীঃ ভালোবাসার দেবী। তিনি কামনার দেবিতা মন্মথ মদনের স্ত্রী।
৬. কলি দেবঃ কলি যুগের দেবতা।
৭. অঙ্গীরাঃ মহর্ষি। তার আশ্রমেই শেষে পদ্মাবতীর আশ্রয় হয়েছিলো।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
হরিণ শিকারে গিয়ে হরিণের পিছু নিয়ে ঐশ্বর্যের দেবতা যক্ষরাজ কুবেরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিন্ধাপর্বতের অনেকটাই উপরে উঠে পড়েন বিদর্ভনগরের রাজা ইন্দ্রনীল। কিন্তু সহসা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। কারণ ঐ সময় বিন্ধা পর্বতে এসে উপস্থিত হন দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী শচী, কুবেরের স্ত্রী মুরজা এবং তাদের দৈবিক মায়ায় ইন্দ্রনীলের এই গভীর নিদ্রা। প্রায় পনেরো বছর আগে দেবী পার্বতী কর্তৃক অভিশাপগ্রস্থ হয়ে পৃথিবীর কোন এক অজানা গৃহে জন্ম নেয়া স্বীয় কন্যা বিজয়ার বিষয়ে তারা যখন আলাপচারিতায় ব্যস্ত তখন সেখানে উপস্থিত হন ভালবাসার দেবী এবং কামনার দেবতা মদনের স্ত্রী রতি।
তাদের আলাপের মাঝে সেখানে উপস্থিত হন সর্বজ্ঞ দেবর্ষি নারদ। শচীর মনে নিজের সম্পর্কে অপমান জনক ভাবনা সম্পর্কে জেনে তিনি উপস্থিত তিন দেবীর মধ্যে কলহ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাদের একটি স্বর্ণ পদ্ম দেখিয়ে বলেন এটি দৈব নির্দেশে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী দেবী প্রাপ্ত হবেন। সাথে সাথেই তার কামনা অনুযায়ী স্বর্ণপদ্মটি পাওয়ার আশায় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিন দেবী। তখন নারদ মুণীই তাদের উপায় বাতলে দেন যে ঘুমন্ত ইন্দ্রনীলকে জাগিয়ে তার কাছ থেকে দেবীদের সৌন্দর্যের বিষয়ে মিমাংসা নিতে।
দেবর্ষির পরামর্শ মতোই তিন দেবী রাজা ইন্দ্রনীলের সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে মায়ানিদ্রা থেকে মুক্ত করে তার সম্মুখে নিজেদের সমস্যা উপস্থাপন করেন। তিন দেবীই তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ইন্দ্রাণী শচী তাকে পৃথিবীতে দেবত্ব দানের, কুবেরপত্নী মুরজা ঐশ্বর্য দানের এবং রতি প্রেমের প্রলোভন দেখান। কিন্তু চিরমোহিনী রতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনীল তাকেই স্বর্ণকমলের অধিকারী নির্বাচিত করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেবী শচী ও মুরজা তাকে শাস্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন কিন্তু রতি তাকে এসব থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
এর কিছুকাল পরেই রতি দ্বারা সপ্নাদিষ্ট হয়ে মাহেশ্বরীপুরীর রাজা তার কন্যা পদ্মাবতীর স্বয়ংবর আয়োজন করেন। সেই স্বয়ংবরে সরাসরি অংশ না নিলেও বণিক বেশে উপস্থিত হন ইন্দ্রনীল কারণ রতির প্রভাবেই পদ্মাবতীকে স্বপ্নে দেখে তার অপরূপ রূপে মোহিত হয়েছিলেন তিনি। একই ঘটনা ঘটে পদ্মাবতীর ক্ষেত্রে। সেও বারংবার স্বপ্নে ইন্দ্রনীলের সৌন্দর্য দেখে তার অসাক্ষাতেই তাকে মন সঁপেছেন। এক পর্যায়ে প্রাসাদের সরোবরের পাশে একে অপরের পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞাত এই দুই স্বপ্নপ্রাপ্ত ব্যক্তি একে অপরকে দেখেন। পদ্মাবতীর অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায়। সে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিল বিধায় স্বয়ংবরে উপস্থিত হতে না পারায় ব্যর্থ মনোরথে ফেরত যান উপস্থিত হওয়া রাজা ও রাজপুত্রগণ। তবে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়ে তাদের মধ্য বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং পদ্মাবতী হন বিদর্ভনগরের রাজমহিষী।
অপরদিকে, রাজা ইন্দ্রনীল মানবকুলের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী পদ্মাবতীকে লাভ করায় এবং রতি দেবীর সাফল্যে হিংসায় কাতর দেবী শচী ও মুরজা ইন্দ্রনীলকে শাস্তি দিতে কলি দেবতার স্মরণাপন্ন হন। কলি দেবতার ষড়যন্ত্রে স্বয়ংবরে ব্যর্থ সকল রাজা একযোগে বিদর্ভনগর আক্রমণ করেন। যুদ্ধ চলাকালে যখন ইন্দ্রনীল ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত তখন কলি দেবতা সারথির ছদ্মবেশে পদ্মাবতীর কাছে এসে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তাকে তার সখী বসুমতিসহ অপহরণ করে
এবং এক জনশূন্য শ্বাপদসংকুল অরণ্যে রেখে আসেন। পাশাপাশি সে এক যুদ্ধাহত সেনার বেশে রাণীর কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে রাজার মৃত্যুর সংবাদ দেন।
যুদ্ধফেরত রাজা ইন্দ্রনীল এবং অপহৃত রাজমহিষী পদ্মাবতী উভয়েই একে অপরের বিচ্ছেদে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন। তাদের এই দুঃখ ও গভীর এই অরণ্যে রাণীর নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে কাঠকুড়ানির বেশ ধরে দেবী রতি রাণীকে ঐ অরণ্যের পার্শবর্তী এক আশ্রমে মহর্ষী অঙ্গীরার নিকট রেখে আসে এবং দেবীর দুর্গার কাছে গিয়ে পদ্মাবতীর দুঃখের কথা জানান। অবশেষে দুর্গার আদেশে নারদমুণি ইন্দ্রনীলের কাছে পদ্মাবতীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেন এবং তাকে সাথে করে মহর্ষীর আশ্রমে নিয়ে যান। অবশেষে মিলত হন ইন্দ্রনীল এবং পদ্মাবতী।
একই সময়ে মুরজা জানতে পারেন যে, এই পদ্মাবতীই তার অভিশপ্ত কন্যা বিজয়া। বিজয়া অর্থাৎ পদ্মাবতীর উপর নিজেদের কৃত অন্যায় কাজে লজ্জিত হন মুরজা এবং দেবী শচী ও মুরজা পদ্মাবতীকে আশির্বাদ করেন।
এই হলো পদ্মাবতী নাটকের গল্প। আজকের মতে এখানেই সমাপ্তি।
রচনা ও প্রকাশঃ প্রচলিত তথ্যমতে ১৮৬০ সালে মাইকেল মধুসূদন দত্ত এই নাটকটি রচনা করেন এবং ঐ বছরেই এটি প্রকাশিত হয়। তবে কবির জীবনপাঠে জানা যায় এটি ১৮৫৯ সালে রচিত হয় এবং ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়।
বিশেষত্বঃ
১. এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক কমেডি
২. এই নাটকের পদ্যাংশের মাধ্যমেই কবি সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরীক্ষামূলক ব্যবহার করেন।
বিষয়বস্তুঃ
এই নাটকে নাট্যকার গ্রীক পৌরাণিক গল্পকে দেশীয় দেব দেবীদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করে দেশী আবহাওয়ায় সাজিয়েছেন। এটিকে গ্রীক পুরাণের অ্যাপল অব ডিসকর্ডের দেশীয় সংস্করণ বললে অত্যুক্তি হবে না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই এটিকে মৌলিক সৃষ্টিকর্ম হিসেবে মেনে নিতে চাননা।
মূলগল্পঃ
গ্রিক পুরাণের গল্পটির সূচনায় দেখানো হয় স্বর্গে উপদেবী থেটিস সমুদ্র দেবতা পোসাইডন কে পরিত্যাগ করে বিয়ে করছিলেন মানব পেলিয়াসকে। এরাই গ্রিক বীর অ্যাকিলিসের পিতামাতা। এই বিবাহ অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন সকল দেবদেবী। কিন্তু বাদ পরে যান বিবাদের দেবী এরিস। ক্রুদ্ধ দেবী এরিস এবার হেসপেরাডাইসের বাগান থেকে একটি সোনার আপেল এনে সোনালি কাপড়ে মুড়ে তা ছুড়ে দেন ভোজ সভায়। সেই মোড়কে লিখা ছিল সর্বাপেক্ষা সুন্দরী দেবী এই আপেলের মালিক হবেন। দাবি নিয়ে এগিয়ে এসে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিন দেবী- বিবাহের দেবী ও দেবরাজ জিউসের স্ত্রী হেরা, জ্ঞানের দেবী এথেনা ও সৌন্দর্য ও ভালোবাসার দেবী আফ্রোদিতি। দেবকুলের কেউ তাদের বিবাদের মিমাংসা করতে ব্যর্থ হলে জিউসের পরামর্শে এই তিনজন দেবী পৃথিবীতে যান ট্রয়ের রাজা প্রায়ামের পুত্র প্যারিসের কাছে।
হেরা প্যারিসকে রাজত্বের, এথেনা যুদ্ধজ্ঞানের এবং আফ্রোদিতি প্রেমের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী হিসেবে নির্বাচিত করার অনুরোধ জানান। কিন্তু প্যারিসের কাছে রাজত্ব, যুদ্ধজ্ঞানের চেয়ে সৌন্দর্যের আকর্ষণ বেশি হওয়ায় সে আফ্রোদিতির সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে তাকে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী এবং স্বর্ণ আপেলের দাবিদার বলে ঘোষণা করেন।
তার এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়ে আফ্রোদিতি তাকে বর প্রদান করেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী নারী লাভ করবেন প্যারিস। কিন্তু ক্ষিপ্ত দেবমাতা হেরা এবং জ্ঞানদেবী এথেনা তার জীবন নারকীয় কষ্টে পূর্ণ করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
দেবীদের প্রত্যেকেই তাদের প্রতুশ্রুতি রক্ষা করেন। দেবী আফ্রোদিতির প্রভাবে প্যারিসের ভালোবাসায় মজেন যুদ্ধবাজ হিসেবে খ্যাত স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হেলেন। কিন্তু হেরার কারণে সেই প্রণয় পরিণয়ে রূপান্তরের পথে আসে হাজারো বাঁধা। এথেনার প্রভাবে মেনেলাউসের ভাই আগামেননের নেতৃত্বে ও প্ররোচনায় সকল গ্রিক নগর রাষ্ট্রের সম্মিলিত সৈন্যবাহিনী ট্রয় আক্রমণ করেন এবং এপোলোর অভিশাপের বাস্তবায়নে প্যারিসের কারণেই তার পিতৃরাজ্য ধংশ হয়। যদিও আফ্রোদিতির চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত মিলন হয় প্যারিস ও হেলেনের।
পদ্মাবতীর চরিত্র চিত্রণঃ
পদ্মাবতীতে নাট্যকার গ্রিক চরিত্র সমূহকে দেশীয় দেবদেবীদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করেছেন সম্পূর্ণ দেশীয় আবহে। প্রথমেই চরিত্র সমূহের সাথে পরিচিত হওয়া যাক।
১. ইন্দ্রনীলঃ বিদর্ভনগরের রাজা। প্যারিসের স্থলে তাকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
২. পদ্মাবতীঃ মাহেশ্বরীপুরির রাজকন্যা এবং নাটকের নাম চরিত্র।
৩. শচী দেবীঃ দেবরাজ ইন্দ্রের স্ত্রী।
৪. মুরজা দেবীঃ ধনপতি কুবেরের স্ত্রী
৫. রতি দেবীঃ ভালোবাসার দেবী। তিনি কামনার দেবিতা মন্মথ মদনের স্ত্রী।
৬. কলি দেবঃ কলি যুগের দেবতা।
৭. অঙ্গীরাঃ মহর্ষি। তার আশ্রমেই শেষে পদ্মাবতীর আশ্রয় হয়েছিলো।
কাহিনী সংক্ষেপঃ
হরিণ শিকারে গিয়ে হরিণের পিছু নিয়ে ঐশ্বর্যের দেবতা যক্ষরাজ কুবেরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিন্ধাপর্বতের অনেকটাই উপরে উঠে পড়েন বিদর্ভনগরের রাজা ইন্দ্রনীল। কিন্তু সহসা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। কারণ ঐ সময় বিন্ধা পর্বতে এসে উপস্থিত হন দেবরাজ ইন্দ্রের পত্নী শচী, কুবেরের স্ত্রী মুরজা এবং তাদের দৈবিক মায়ায় ইন্দ্রনীলের এই গভীর নিদ্রা। প্রায় পনেরো বছর আগে দেবী পার্বতী কর্তৃক অভিশাপগ্রস্থ হয়ে পৃথিবীর কোন এক অজানা গৃহে জন্ম নেয়া স্বীয় কন্যা বিজয়ার বিষয়ে তারা যখন আলাপচারিতায় ব্যস্ত তখন সেখানে উপস্থিত হন ভালবাসার দেবী এবং কামনার দেবতা মদনের স্ত্রী রতি।
তাদের আলাপের মাঝে সেখানে উপস্থিত হন সর্বজ্ঞ দেবর্ষি নারদ। শচীর মনে নিজের সম্পর্কে অপমান জনক ভাবনা সম্পর্কে জেনে তিনি উপস্থিত তিন দেবীর মধ্যে কলহ সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাদের একটি স্বর্ণ পদ্ম দেখিয়ে বলেন এটি দৈব নির্দেশে সর্বাপেক্ষা সুন্দরী দেবী প্রাপ্ত হবেন। সাথে সাথেই তার কামনা অনুযায়ী স্বর্ণপদ্মটি পাওয়ার আশায় বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তিন দেবী। তখন নারদ মুণীই তাদের উপায় বাতলে দেন যে ঘুমন্ত ইন্দ্রনীলকে জাগিয়ে তার কাছ থেকে দেবীদের সৌন্দর্যের বিষয়ে মিমাংসা নিতে।
দেবর্ষির পরামর্শ মতোই তিন দেবী রাজা ইন্দ্রনীলের সামনে উপস্থিত হয়ে তাকে মায়ানিদ্রা থেকে মুক্ত করে তার সম্মুখে নিজেদের সমস্যা উপস্থাপন করেন। তিন দেবীই তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেন। এর মধ্যে ইন্দ্রাণী শচী তাকে পৃথিবীতে দেবত্ব দানের, কুবেরপত্নী মুরজা ঐশ্বর্য দানের এবং রতি প্রেমের প্রলোভন দেখান। কিন্তু চিরমোহিনী রতির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনীল তাকেই স্বর্ণকমলের অধিকারী নির্বাচিত করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দেবী শচী ও মুরজা তাকে শাস্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন কিন্তু রতি তাকে এসব থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
এর কিছুকাল পরেই রতি দ্বারা সপ্নাদিষ্ট হয়ে মাহেশ্বরীপুরীর রাজা তার কন্যা পদ্মাবতীর স্বয়ংবর আয়োজন করেন। সেই স্বয়ংবরে সরাসরি অংশ না নিলেও বণিক বেশে উপস্থিত হন ইন্দ্রনীল কারণ রতির প্রভাবেই পদ্মাবতীকে স্বপ্নে দেখে তার অপরূপ রূপে মোহিত হয়েছিলেন তিনি। একই ঘটনা ঘটে পদ্মাবতীর ক্ষেত্রে। সেও বারংবার স্বপ্নে ইন্দ্রনীলের সৌন্দর্য দেখে তার অসাক্ষাতেই তাকে মন সঁপেছেন। এক পর্যায়ে প্রাসাদের সরোবরের পাশে একে অপরের পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞাত এই দুই স্বপ্নপ্রাপ্ত ব্যক্তি একে অপরকে দেখেন। পদ্মাবতীর অস্থিরতা আরও বৃদ্ধি পায়। সে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিল বিধায় স্বয়ংবরে উপস্থিত হতে না পারায় ব্যর্থ মনোরথে ফেরত যান উপস্থিত হওয়া রাজা ও রাজপুত্রগণ। তবে শেষ পর্যন্ত ইন্দ্রনীলের পরিচয় সম্পর্কে অবগত হয়ে তাদের মধ্য বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং পদ্মাবতী হন বিদর্ভনগরের রাজমহিষী।
অপরদিকে, রাজা ইন্দ্রনীল মানবকুলের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী পদ্মাবতীকে লাভ করায় এবং রতি দেবীর সাফল্যে হিংসায় কাতর দেবী শচী ও মুরজা ইন্দ্রনীলকে শাস্তি দিতে কলি দেবতার স্মরণাপন্ন হন। কলি দেবতার ষড়যন্ত্রে স্বয়ংবরে ব্যর্থ সকল রাজা একযোগে বিদর্ভনগর আক্রমণ করেন। যুদ্ধ চলাকালে যখন ইন্দ্রনীল ভীষণ যুদ্ধে লিপ্ত তখন কলি দেবতা সারথির ছদ্মবেশে পদ্মাবতীর কাছে এসে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে তাকে তার সখী বসুমতিসহ অপহরণ করে
এবং এক জনশূন্য শ্বাপদসংকুল অরণ্যে রেখে আসেন। পাশাপাশি সে এক যুদ্ধাহত সেনার বেশে রাণীর কাছে যুদ্ধক্ষেত্রে রাজার মৃত্যুর সংবাদ দেন।
যুদ্ধফেরত রাজা ইন্দ্রনীল এবং অপহৃত রাজমহিষী পদ্মাবতী উভয়েই একে অপরের বিচ্ছেদে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েন। তাদের এই দুঃখ ও গভীর এই অরণ্যে রাণীর নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনা করে কাঠকুড়ানির বেশ ধরে দেবী রতি রাণীকে ঐ অরণ্যের পার্শবর্তী এক আশ্রমে মহর্ষী অঙ্গীরার নিকট রেখে আসে এবং দেবীর দুর্গার কাছে গিয়ে পদ্মাবতীর দুঃখের কথা জানান। অবশেষে দুর্গার আদেশে নারদমুণি ইন্দ্রনীলের কাছে পদ্মাবতীর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেন এবং তাকে সাথে করে মহর্ষীর আশ্রমে নিয়ে যান। অবশেষে মিলত হন ইন্দ্রনীল এবং পদ্মাবতী।
একই সময়ে মুরজা জানতে পারেন যে, এই পদ্মাবতীই তার অভিশপ্ত কন্যা বিজয়া। বিজয়া অর্থাৎ পদ্মাবতীর উপর নিজেদের কৃত অন্যায় কাজে লজ্জিত হন মুরজা এবং দেবী শচী ও মুরজা পদ্মাবতীকে আশির্বাদ করেন।
এই হলো পদ্মাবতী নাটকের গল্প। আজকের মতে এখানেই সমাপ্তি।
No comments